বিএনপিকর্মী সন্টু এখন যখন-তখন কোপান

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে
ছবি : বাবা জিনারুল ইসলাম, ছেলে সন্টু

বিএনপিকর্মী উবায়দুর রহমান ঝিনাইদহ শহর থেকে শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরছিলেন। সদর উপজেলার পাগলাকানাই ইউনিয়নের দেওয়ান বাজারে তাঁর ওপর অতর্কিত হামলা করেন প্রবাসফেরত মোহাম্মদ সন্টু। ধারালো অস্ত্র দিয়ে উবায়দুরকে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। তাঁর দুই হাত, দুই পা ও চোখে গুরুতর আঘাত লেগেছে। বর্তমানে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উবায়দুর। এ ঘটনায় মামলা হলে সন্টু ও তাঁর বাবা পাগলাকানাই ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি জিনারুল ইসলাম পালিয়ে যান।

উবায়দুরের ওপর হামলার সংবাদে এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, চার মাসে সন্টুর ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও মারধরে অন্তত ৮ জন আহত হয়েছেন। এর পেছনে তাঁর বাবা জিনারুলের ইন্ধন রয়েছে। জিনারুলের বাড়ি পাগলাকানাই ইউনিয়নের বাড়িবাথান গ্রামে। শনিবার সেখানে গিয়ে কথা হয় এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারা জানান, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন সন্টু। সেখানে একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কারাভোগ শেষে ২০২২ সালে দেশে ফেরেন। এর পর কোনো অপকর্মের সংবাদ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হঠাৎই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এলাকাবাসী জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা আর বাবা বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় সন্টু ধরাকে যেন সরা জ্ঞান করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, বাড়ির বাইরে বের হতেই ভয় লাগছে। বাবার প্রশ্রয়েই সন্টু বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। পুলিশও তাঁকে গ্রেপ্তার করছে না।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন বিএনপির মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়। অনেকেই দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তখন বিএনপির একটি পক্ষের নেতা ছিলেন জিনারুল ইসলাম। পরে ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতিও হন।

জানা যায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাড়িবাথান দুর্গাপাড়ায় এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলেন সন্টু। এ সময় তাঁর সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রবাসফেরত এক ব্যক্তি। সন্টু হঠাৎ ওই ব্যক্তিকে বলতে শুরু করেন, ‘আপনি আমাদের কথা শুনছেন কেন?’ এ বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হয়। এক পর্যায়ে সন্টু ওই ব্যক্তিকে মারধর শুরু করেন। পাশের দোকান থেকে তাঁর ছেলে ও এক পথচারী এগিয়ে এলে তাদের কোপানো হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় গেলেও মামলা নেয়নি পুলিশ। দ্বিতীয়বার হামলার শঙ্কায় তারা নাম প্রকাশে রাজি হননি।

পরের ঘটনাটি ২২ অক্টোবরের। এদিন এশার নামাজের পর রাজাপুর গ্রামের মসজিদের পাশে আহসান হাবিব ইমরোজ নামের এক তরুণের কাছে প্রতিবেশী একজনের ফোন নম্বর চান সন্টু। ইমরোজ জানায়, নম্বর সে জানে না। কিছু না বলেই তাকে চড়থাপ্পড় মারতে থাকেন সন্টু। এ সময় ইমরোজের বাবা ও আরেকজন লোক ছুটে এলে তাদের কোপানো হয়। সেখান থেকে ফেরার পথে সন্টু পেয়ে যান সাকিবুল হাসান ইমন নামের আরেক তরুণকে। ইমন কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন সন্টু। এ ঘটনায় রাতেই ইমনের মা রেশমা খাতুন বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা করেন। রেশমার ভাষ্য, তাঁর ছেলের পুরো শরীরে ২৬-২৭টি কোপ দিয়েছেন সন্টু ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যরা। কিন্তু পুলিশ আসামি ধরতে কোনো চেষ্টাই করেনি। পরে সন্টু ও তাঁর বাবা জিনারুল মামলা তুলে নিতে হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু করেন। বাধ্য হয়ে কয়েক দিন পরই মামলা প্রত্যাহার করেন।

সর্বশেষ শুক্রবার হামলার শিকার উবায়দুর রহমানের মেয়ে শিরিনা খাতুন থানায় মামলা করেন। তাঁর ভাষ্য, আমার বাবা বিএনপি করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাঁর নামে বিভিন্ন ঘটনায় পাঁচটি মামলা হয়। কিন্তু কোনো বিএনপি নেতা এগিয়ে আসেননি।

শিরিনা বলেন, অর্থাভাব ও মামলা থেকে বাঁচতে তাঁর বাবা আওয়ামী লীগ নেতা পাগলাকানাই ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাইদ বিশ্বাসের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আওয়ামী লীগ পতনের পর জিনারুল ও সন্টু তাদের গ্রুপে যোগ দিতে বলেন। এ কথা না শোনায় জিনারুল ও সন্টুর নেতৃত্বে হামলা হয়। অথচ পুলিশ তাদের আইনের আওতায় আনছে না।

এ ঘটনায় শিরিনার মামলার ৪ নম্বর আসামি চান মিয়াকে রোববার দুপুরে বাড়িবাথান থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চান মিয়াও স্বীকার করেন, হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সন্টু।

এলাকাবাসী জানায়, এক বছর আগে পাগলাকানাই ইউনিয়ন পরিষদের সামনে হামলার শিকার হন জেলা যুবদলের সদস্য লিটন মণ্ডল। তাঁকে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। লিটন সম্পর্কে সন্টুর চাচাতো ভাই। লিটনের ওপর হামলায় উবায়দুর জড়িত ছিলেন, এমন অভিযোগও ছিল। এ কারণে তাঁর ওপর হামলা করেছেন সন্টু।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে জিনারুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও সংযোগ মেলেনি। শনিবার বাড়িবাথানের বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। জিনারুলের স্ত্রী আফরোজা বলেন, স্বামী ও ছেলে কোথায় আছেন, তা জানেন না।

শুক্রবার উবায়দুরের ওপর হামলার সময় ঘটনাস্থলে মোবাইল ফোন ফেলে চলে যান সন্টু। এ সময় তাঁর ফোনে বারবার কল আসছিল চাচাতো ভাই লিটন মণ্ডলের নম্বর থেকে। সেই মোবাইল ফোনটি পুলিশ জব্দ করে। কলের বিষয়ে জানতে চাইলে লিটন বলেন, একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি শুনেছি। তখনই ভাইয়ের নম্বরে কল করেছি। আমার ভাই, অবশ্যই আমি তাঁকে ফোন করতে পারি। আর উবায়দুর তো ভালো মানুষ না। আমাকে যখন কোপানো হয়েছিল, তখন উবায়দুরও ছিল।’ তবে এ ঘটনার জেরেই হামলা হয়েছে কিনা, এ প্রশ্নের উত্তর দেননি লিটন।

ঝিনাইদহ সদর থানা বিএনপির সভাপতি মুন্সী কামাল আজাদ পান্নুর ভাষ্য, সন্টু সন্ত্রাসী ছেলে। বিভিন্ন সময় নেশা করত বলে শুনেছি। সে মালয়েশিয়াতেও জেল খেটেছিল। দেশে ফিরেও একই অপরাধ ঘটাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবহেলার কারণেই এমন ঘটনার সুযোগ পাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি। মুন্সী কামাল আজাদ আরও বলেন, সন্টুর বাবা জিনারুলের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। যদি সত্যতা পাওয়া যায়, তবে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্‌) মুহাম্মদ মহিদুর রহমান জানান, কেন আগে গ্রেপ্তার হয়নি বা মামলা নেওয়া হয়নি সে বিষয়টি দেখছেন। এবার মামলা হয়েছে, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। সন্টু-জিনারুলসহ আসামিদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে।

সূত্র : সমকাল
  • ঝিনাইদহ
  • বিএনপিকর্মী
  • সন্টু
  • #