আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসনের আগমনকে ঘিরে পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশ শুরু হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও ক্ষমতায় না বসলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৭ তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব শুরু করলে কী ঘটবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কেবল বেড়েই চলেছে।
মার্কিন অর্থনীতির জন্য উচ্চ শুল্কের অর্থ কী? বেশিরভাগ বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে মার্কিন শুল্কের একটি বড় বৃদ্ধি মার্কিন অভ্যন্তরীণ চাহিদার উপর একটি ম্লান প্রভাব ফেলবে। কারণ প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা উচ্চতর পণ্যের মূল্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বিনিয়োগ উচ্চ বাণিজ্য অনিশ্চয়তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। উচ্চতর আমদানি শুল্ক প্রাথমিকভাবে মুদ্রাস্ফীতিমূলক। কারণ শুল্ক খরচ ভোক্তাদের কাছে চলে যায়। যাই হোক, প্রকৃত আয়ের উপর আঘাত আনলে শেষ পর্যন্ত ধীর গতির চাহিদা বৃদ্ধি এবং প্রাথমিক এক দফা মূল্যবৃদ্ধির পর ভিত্তি প্রভাবের ফলে মূল্যস্ফীতি আবার কমে আসে। এরই মধ্যে প্রত্যাশা মতো মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার কমিয়েছে। জেঁকে বসা মূল্যস্ফীতি কমাতে ফেডারেল রিজার্ভের কর্মকর্তারা সুদের হার হ্রাসের যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন, সেখান থেকে তারা যে খানিকটা পিছিয়ে এসেছেন কেবল তাই নয়, বরং তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেছেন, ব্যাংকের অনেকেই ভাবছেন ট্রাম্পের পরিকল্পিত শুল্ক আরোপ, করহার হ্রাস এবং অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ তাদের নীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন যে, প্রত্যাশার তুলনায় আগামী বছরে প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। পাশাপাশি তারা ধারণা করছেন যে, মূল্যস্ফীতি ও বাড়বে।
রয়টার্সের একটি জরিপে দেখা যায়, ট্রাম্পের নীতিমালা জাপানের ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক অব জাপান সম্ভবত এই বিষয়টি আমলে নিয়েছে। উন্নত বিশ্বে জাপানই একমাত্র দেশ, যারা এখনো সংকোচনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাসহ একাধিক পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে বেশ গুরুত্ব সহকারে মার্কিন ভূ-খণ্ড বাড়ানোর কথা ভাবছেন সদ্য নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে জোর দেওয়া হয়েছিল ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতির ওপর। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একাধিকবার ‘আঞ্চলিক সম্প্রসারণের’ ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।
২০২৪-এর নির্বাচনে রিপাবলিকানদের নমিনেশন পাওয়ার আগেই ট্রাম্পের কিছু বক্তব্য পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। তার মাঝে একটি হচ্ছে প্রস্তাবিত ‘বেজলাইন ট্যারিফ’। ট্রাম্পের ভাষ্যমতে এই বেজলাইন ট্যারিফের আওতায় থাকবে সকল আমদানিকৃত পণ্য। নূন্যতম ট্যাক্স থাকবে ১০%। অর্থাৎ যে সকল পণ্য দীর্ঘদিন ধরে বিনা অথবা স্বল্প শুল্ক সুবিধাতে আমেরিকান বাজারে পৌঁছেছে তাদের সুবিধা মাটিতে মিশে যাবে মুহূর্তেই । নমিনাল জিডিপির দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির প্রতিটি আমদানি পণ্যে যদি নূন্যতম ১০% ট্যাক্স আরোপিত হয়, তবে তা চিন্তার বিষয় বটে।
বাণিজ্যযুদ্ধ নাকি অর্থনৈতিক সহাবস্থান? ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প যখন পুনরায় কার্যভার গ্রহণ করবেন, তখন চীন ইতোমধ্যেই ওয়াশিংটনের কঠোর অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থাকবে। তবে তিনি এবং তার সহযোগীরা জোর দিয়েছিলেন যে এগুলো চীনের উত্থান সীমাবদ্ধ করার জন্য ক্ষীণভাবে যথেষ্ট হবে না। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে, তার নতুন মেয়াদের প্রথম দিনে তিনি সমস্ত চীনা আমদানির উপর শুল্ক শতকরা ২৫ ভাগ হতে দ্বিগুণ হতে পারে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত এবং অন্যান্য কঠোর পদক্ষেপের সাথে তা অনুসরণ করবেন।
প্রথম মেয়াদে ও ট্রাম্প চীন, মেক্সিকো, কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোর বিরুদ্ধে আগ্রাসী বাণিজ্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সে সময় চীনের হাজারো কোটি ডলার মূল্যমানের আমদানি পণ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য পরিমানে শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করেন ট্রাম্প। সে সময় তিনি অন্যায্য বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া, মেধাস্বত্ব চুরি ও দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। চীন ও পাল্টা জবাবে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে। এতে মার্কিন খামারিরা বড় আকারে ক্ষতির শিকার হন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মতে, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে চীনকে লক্ষ্য করে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং মার্কিন বাণিজ্যনীতির একতরফা পরিবর্তন অব্যাহত রাখতে পারেন। বিবিসি জানাচ্ছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল, চীনকে একটি প্রযুক্তিগত পরাশক্তিতে পরিণত করা। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বিজয় এখন তার ওই পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্থ করবে বলে মনে হচ্ছে। এটি স্পষ্ট যে তার এই বিজয় বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির সম্পর্কের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
ব্রিকস দেশগুলো একুশ শতকের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে। তারা মার্কিন ডলারের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে আগ্রহী। ব্রিকস দেশগুলোর উপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলো চীনের বাইরেও বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংঘাতের বৃহত্তর প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে। অর্থনৈতিক যুদ্ধের এই প্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং যুগের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে ব্রিকস জোটের মধ্যে যারা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, মিশর, ইথিওপিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্তর্ভূক্ত। ট্রাম্পকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, ব্রিকস দেশগুলো মার্কিন আধিপত্য ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে না, বরং তারা ডলারের অপ্রতিরোধ্য আধিপত্যের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করার লক্ষ্য রাখে।
গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ট্রাম্প সোশ্যালে লিখেছেন, অনেক কানাডিয়ান চায় কানাডা আমেরিকার ৫১ তম অঙ্গরাজ্য হোক। আমেরিকা ও কানাডার মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। ফক্স নিউজ জানিয়েছে, শুল্ক নিয়ে ট্যুডোর উদ্বেগ প্রকাশের পরেই ট্রাম্প মজার ছলে এমন মন্তব্য করেছেন। পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প এমন মন্তব্য যে আসলেই মজার ছলে করেছেন তা বোঝার চেষ্টা করছে কানাডা। কিন্তু, ব্যাপারটা কি হলো? গত ৬ জানুয়ারি ২০২৫ ট্র্যুডোর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার অন্যতম কারণ ছিলেন ট্রাম্প। দেশটির বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ মনে করছিলেন, তাদের ওপর শুল্ক আরোপের যে হুমকি ট্রাম্প দিয়েছেন সেটি ট্র্যুডো আটকাতে পারবেন না।
পানামা খালের দিকেও নজর দিয়েছেন ট্রাম্প। পানামা খালের দখল ফিরিয়ে নেওয়ার ও হুুমকি দিয়েছেন। পানামা খাল সম্পর্কে ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো রাজনৈতিক, কারণ মার্কিনরা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমাতে চায়। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পানামা খালের ব্যবহার নিয়ে কুটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যা ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ বিশ্ব বাণিজ্যের লক্ষ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর মাধ্যমে পানামা খাল পরিচালনার প্রভাব বাড়াতে শুরু করেছে চীন। এতে ক্ষুব্দ হয় যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প ডেনমার্কের তত্ত্বাবধানে স্বশাসিত দ্বীপরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড কিনে নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমনকি এই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি কিংবা অর্থনৈতিক পদক্ষেপের কথাও জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কঠোর অভিবাসন নীতির জন্য আমেরিকার ইতিহাসে ট্রাম্প প্রশাসন বিখ্যাত। গতবারের মতো এবারও তার ভোট জয়ের বড় একটি হাতিয়ার ছিল অভিবাসী সমস্যা। তবে এক্ষেত্রে আলোচনার মূলে থাকে লাতিন আমেরিকার সাথে আমেরিকার বর্ডার। কিন্তু এর পাশাপাশি নাগরিকত্ব, ভিসা ইত্যাদি প্রদানের ক্ষেত্রে গত শাসনামলে বেশ কঠোর ছিলেন ট্রাম্প। অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করার জন্যে এমনকি বৈধ অভিবাসন কমানোর জন্য গত শাসনামলে ট্রাম্প প্রশাসন অন্তত ৪০০টি নির্বাহী আদেশ জারি করেছে। তাই, ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে বলেন, ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর আমি অনেকগুলো নির্বাহী আদেশ জারি করব। ট্রাম্পের অর্থনৈতিক কৌশলের মূলে রয়েছে কর ও শুল্ক আরোপ।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে বাংলাদেশ সর্বমোট ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। যার ভেতর ৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারই ছিল তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্য। যদিও বাংলাদেশের তৈরি পোষাক আমদানি করতে মার্কিন আমদানিকারকদের পরিশোধ করতে হয় ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ট্যাক্স। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারীর তালিকায় প্রথম অবস্থানটি দীর্ঘদিন ছিল আমেরিকার দখলে। ২০২৩ সালে সে স্থান চীনের হলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনও এদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ সহযোগী। বাংলাদেশে আমেরিকান বিনিয়োগের মূল ক্ষেত্র মূলত এনার্জি সেক্টর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ট্রাম্প প্রশাসনের সময়েই বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে যে আমেরিকা আমরা দেখেছিলাম এবার তার চেয়ে আরো বেশি কট্টর হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। এটা শুধু আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এটা একাট বৈশ্বিক ট্রেন্ডে পরিণত হবে। যা পুরো বিশ্বব্যবস্থা এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে।