গত ডিসেম্বরের চেয়ে চলতি জানুয়ারি মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন না থাকলেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের অর্ন্তদ্বন্দ্ব থেকে হওয়া সহিংসতায় হতাহত সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে দুস্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক নেতা‑কর্মীদের নিহত হওয়ার ঘটনা। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে এই মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন। গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে বিভিন্ন পরিস্থিতি আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির দলীয় কর্মীদের অর্ন্তদ্বন্দ্ব লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে, যা জনমনে নিরাপত্তহীনতা ও ভীতির সৃষ্টি করেছে। জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৮টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছে ৬০৪ জন। তাদের মধ্যে ১০ জন নিহত ও ৫৯৪ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ। নিহতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপির, ৩ জন আওয়ামী লীগের, ১ জন জামায়াতের ও ১ জন নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি।
সহিংসতার ৫৮টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বের ৪১টি, আওয়ামী লীগের ২টি, বিএনপি-আওয়ামী লীগ ১২টি, বিএনপি-জামায়াত ২টি ও ১টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে কারা হেফাজতে মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল ৬। এ মাসে ৩ জন কয়েদি ও ৫ জন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১ জন, নীলফামারী জেলা কারগোরে ২ জন, গাজীপুর জেলা কারাগারে ১ জন, মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে ১ জন, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে ১ জন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ও খুলনা জেলা কারাগারে ১ জন বন্দি মারা যান।
এ বিষয়ে এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, কারা অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি বন্দিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে হেফাজতে মৃত্যুর কারণ যথাযথভাবে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় ১২টি মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ৪টি এবং অপর একটি মামলা হয়েছে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের অনিয়মের অভিযোগে।
এ মাসে দায়ের করা কোটা আন্দোলনে মোট মামলায় আসামির তালিকায় সুনির্দিষ্টভাবে নাম রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪২৮ জনের। সেই সঙ্গে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির সংখ্যা কমপক্ষে ২ হাজার ২২৯ জন। লক্ষ্যণীয় যে, এবার প্রথমবারের মতো জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় মামলায় আসামি করা হয়েছে দুবারের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদকে।
জানুয়ারি মাসে সাংবাদিকতার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের যেভাবে শারীরিক‑মানসিক এবং আইনি হয়রানি, আক্রমণ, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, তা শুধু অনাকঙ্ক্ষিতই নয়, বরং সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যদিও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। এ মাসেও সাংবাদিকতার চিত্র উদ্বেগজনক।
জানুয়ারিতে ১৩ ঘটনায় ২১ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে হামলা, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া দুজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হন।
নানাভাবে আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে ১৮ জন সাংবাদিক তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও হামলার শিকার হয়েছেন। লাঞ্ছিত ও হুমকির শিকার হয়েছেন ৩ জন। এ মাসের ১৩টি সাংবাদিক নির্যাতন‑সংক্রান্ত ঘটনার দুটিতে বিএনপি, একটিতে পুলিশ, একটিতে চেয়ারম্যান, একটিতে আনসার প্রহরী, একটিতে বালু-উত্তোলনকারী, একটিতে চোরা কারবারি, একটিতে স্থানীয় প্রভাবশালী, চারটিতে সন্ত্রাসী বাহিনী ও একটিতে সরকারি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা ছিল।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতনের ৪টি এবং জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৫টিসহ মোট ৯টি ঘটনা ঘটেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতনের ৪টি ঘটনায় লালমনিরহাট, দিনাজপুর, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর ও স্বর্ণালঙ্কার চুরির ঘটনা ঘটে।
অন্যদিকে, ৩ জানুয়ারি জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্রে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল নারীকে অভিযুক্ত চেয়ারম্যানের লোকজন জমি দখলকে কেন্দ্র করে মারধর, বাড়িতে আগুন ও যৌন হয়রানি করে।
গত ৭ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের নশরতপুর গ্রামের বছির মেম্বারপাড়ায় ধর্ষণ মামলা ধামাচাপা দিতে ধর্ষণের শিকার সনাতন ধর্মাবলম্বী কিশোরী, তার মা ও ভাইকে পেট্রোল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছেন অভিযুক্ত উপেন চন্দ্র পাল ওরফে কালু (৩৬)।
গত ১৩ জানুয়ারি নাটোরের লালপুরে পঞ্চম শ্রেণির আদিবাসী শিক্ষার্থী দুপুরে ভুট্টাক্ষেতে ঘাস কাটার সময় শাহীন নামক এক ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ করে। অভিযুক্ত শাহীনকে পুলিশ আটক করলেও নির্যাতিত কিশোরীর পরিবার স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত গ্রাফিতি রাখাকে কেন্দ্র করে ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার’ কর্মসূচিতে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামক একটি প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে আসা লোকজন ১৫ জানুয়ারি দুপুরে মতিঝিলের মেট্রো স্টেশনের নিচে হামলা করে। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৬ জানুযারি ‘সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মিছিল করে সচিবালয়ে যাওয়ার পথে পুলিশি হামলার শিকার হয়। এতে ছয় থেকে সাতজন শিক্ষার্থী আহত হন।
নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ৮নং বাহাদুরপুর ইউনিয়নের খড়িবাড়ী শ্যামপুরে ক্ষুদ্র নৃ‑গোষ্ঠীর মোট ২৭টি পরিবারকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পাঁচদিন ধরে বন্দি করে রেখেছে পার্শ্ববর্তী ভূমিদস্যু দখলবাজ সিদ্দিক চৌধুরী গংরা। অথচ প্রায় ৫০-৬০ বছর ধরে এই ওই জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করে আসছে।
এমএসএফ মনে করে, এ ধরনের ঘটনা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবে, যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
সীমান্তে হত্যা, নির্যাতন ও আটক করে ধরে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সীমান্ত হত্যাসহ অন্যান্য ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। বরং অস্থিতিশীল অবস্থা ধারাবহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে।
জানুয়ারি মাসে সীমান্তে বিএসএফের ছোড়া গুলিতে একজন নিহত, দুজন আহত হয়। এ ছাড়া বিএসএফের পিটুনিতে এক বৃদ্ধ ও ভারতীয় নাগরিকদের নির্যাতনে এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ভারত সীমান্ত থেকে দুই বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে দুটি পৃথক স্থলমাইন বিস্ফোরণে এক যুবক এক পা হারিয়েছেন এবং আরও দুজন গুরুতর আহত হয়, যার ফলে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকেরা উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে একই ধারাবাহিকতায় গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে ঘটে চলেছে। চলতি সময়ে গণপিটুনির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নিরাপত্তাবোধের বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ মাসে অন্তত ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ১২ জন নিহত ও ১৮ জন গুরুতর আহত হয়েছে। গণপিটুনির শিকার ২০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ৬ জন চোর সন্দেহে, ২ জন ডাকাতির সন্দেহে, ১ জন ছিনতাইকারী সন্দেহে, ১ জন চাঁদাবাজি, ১ জন বাক-বিতণ্ডার জেরে ১ জন মারামারির ভিডিও ধারণ করায়।
অপরদিকে, ছিনতাই এর অভিযোগে ২ জন, চুরির সন্দেহে ২ জন, অপরাধজনিত ১ জন, চাঁদা চাওয়ায় ৬ জন, পূর্ব শত্রুতার জেরে ৩ জন, ধর্ষণে চেষ্টার অভিযোগে ২ জন, ডাকাতি ও চুরির অভিযোগে ২ জনকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। গণপিটুনিতে আহতের শিকার ১০ জনকে আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট সোপর্দ করা হয়েছে।
এমএসএফ মনে করে, আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ, যা বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। গণপিটুনির সাথে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।