গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

: অলোক আচার্য
প্রকাশ: ৬ দিন আগে

বাংলাদেশের গৌরবময় অধ্যায়ের নাম ১৯৭১। যুদ্ধের নয় মাস বাঙালি জাতির পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই হত্যাযজ্ঞের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাত থেকে। তাদের লক্ষ্য ছিল এদেশের মাটি অস্ত্রের জোরে দখল করা। সেই শহীদদের রক্তে-ভেজা পবিত্র মাটিতেই আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনী পরিকল্পিত আক্রমণে এদেশের মাটি রক্তে ভিজেছিল। ছোটো-বড় সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। নির্বিচারে পরিকল্পিতভাবে কোনো জাতিকে হত্যা করে স্বার্থ হাসিল করাকে গণহত্যা বলে। যার লক্ষ্য থাকে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা।

পৃথিবীর ইতিহাসে বহু গণহত্যার নজির রয়েছে। পলিটিক্যাল ইন্সাটাবিলিটি টাস্ক ফোর্স এর দেয়া তথ্যমতে ১৯৫৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বিশ্বে মোট ৪০টি গণহত্যা সংঘটিত হয়, যেখানে শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রাণ হারানো মানুষের পরিমাণ প্রায় ৫০ লক্ষ। ভয়ঙ্কর সে হত্যায় লাখ লাখ নিরীহ নির্দোষ মানুষের প্রাণ গেছে।

আমাদের দেশেও এই নির্মম মুহূর্তটি এসেছিল। এক ভয়ঙ্কর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে সেই রাতে এদেশের মাটি রক্তে ভিজেছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানী জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানী সেনারা ২৫  মার্চ ১৯৭১ সালের ভয়ঙ্কর এক রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হায়েনার মত হিংস্রতায় ঝাপিয়ে পরেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই রাত ছিল সত্যিকার অর্থেই কালো, বিভীষিকাময়। হত্যা করেছিল একরাতেই লাখো নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। পরে অবশ্য পাকিস্তান তা অস্বীকার করেছে। তার পরের নয় মাস ধরে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন ইপিআর সদরদপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশলাইনে বাঙালিদের ওপর বন্দুক ও কামান নিয়ে হামলা চালায়। এই নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে।

১৯৭১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মানবসভ্যতার ইতিহাসে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বিপরীতে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ হাজার পাঁচশতেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, যা গণহত্যার ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি এইড শানবার্গ যুদ্ধের পরপর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন, যা ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল,  Bengalis’ Land a Vast Cemetery, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘বাঙালির ভূখণ্ড এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র’।

যদিও জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সময়টাই অনেক বছর লেগেছে। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পেরিয়ে গেছে তবে এতদিনেও এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি সামরিকজান্তার দ্বারা সংঘটিত অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন।

২৫ মার্চ কালরাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে অন্তত ৫০ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান বলে বিভিন্ন তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরবর্তী নয় মাসে আরও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী শুধামাত্র পঁচিশে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ঘটনা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হল যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি। এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

গণহত্যা সভ্যতার ইতিহাসে নতুন কোনো ইতিহাস নয়। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার মধ্যে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া, কম্বোডিয়া, হলোকাস্ট ও ন্যানকিং এবং আর্মেনীয় গণহত্যা ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য গণহত্যা। দারফুর গণহত্যাকে একুশ শতকের নৃশংসতম গণহত্যা হিসেবে ধরা হয়। আর রুয়ান্ডার গণহত্যায় ১৯৯৪ সালে সেদেশের সংখ্যালঘু টাটসি গোষ্ঠীর মানুষ এবং সংখ্যাগুরু হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে উদার ও মধ্যপন্থিদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে তার সময়ের ব্যবধানের হিসেবে ১৯৭১ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের চালানো গণহত্যা সংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ।

প্রতিদিনের হিসেবে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে একাত্তরে। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওনের মত ছোট ছোট দেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ঘটা বাঙালিদের ওপর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। এ স্বীকৃতি আদায়ে গতি আনতে হবে। জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা হওয়ার সাথে সাথে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হয়েছে সবাই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে হবে। একটি বিরাট হত্যাযজ্ঞকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা করা হয়। এ প্রস্তাবে সমর্থন দেয় বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য দেশের সদস্যরা। উল্লেখ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তিন বছর ধরে চলা এই গণহত্যায় সেদেশে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। সে সময় আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ লাখ।

বাংলাদেশে গণহত্যা বইতে সিডনির শৈল চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে বলেছেন, ধর্ষিতা মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক দুই লাখ হলেও তার মতে এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন এই সংখ্যা চার থেকে চার লাখ ত্রিশ হাজার এর মত হতে পারে। তিনি আরও বলেন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌনরোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যাত্ব বরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছে। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। জেনেভা কনভেনশন ও জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী, গণহত্যা এমন এক কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়।

আবার ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত ২৬০(৩) রেজুলেশন এর অনুচ্ছেদ-২ এর অধীনে গণহত্যার যে সংজ্ঞায়িত করা হয় তাতেও বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি প্রমাণিত হয় (জেনোসাইড মিউজিয়াম বিডি ডটকম)। এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পেলে তা হবে আমাদের ব্যর্থতা। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবমণ্ডিত অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালিরা মূলত আরেকটি অত্যাচারের অধীনে চলে গিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান শুরু থেকেই বাঙালিদের তাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে চায়নি। তাদের লক্ষ্যও ছিল সেই ব্রিটিশদের মতোই। বাংলার মানুষ নয়, সম্পদের প্রতিই ছিল তাদের লোভ। ফলে অধিকারের জন্য বরাবরই বাঙালিকে লড়তে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে।

’৭০ এর নির্বাচন ছিল বাঙালির দাবি আদায়ের শেষ পদক্ষেপ। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালি বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানীরা তাদের অধিকার কখনোই এমনি এমনি মেনে নেবে না। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে যে রক্তের নদী বইয়ে দেয় তা শেষ হয় দীর্ঘ নয় মাস পর। অনেকেই মনে করেন, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র। এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের মিত্র দেশগুলোর সাথে আলাপ আলোচনা করে এগুতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • ২৫ মার্চ
  • আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
  • গণহত্যা
  • #