আমি মাঝে-মধ্যে নেটফ্লিক্সে এ দু’-চারটা চলচ্চিত্র দেখি। সম্প্রতি দেখলাম মণিকর্নিকার ব্যানারে নির্মিত ও কঙ্গনা রানাউত পরিচালিত ভারতীয় একটি চলচ্চিত্র ‘ইমারজেন্সি’। নাম দেখেই বোঝা গেল ১৯৭৫ সালে ভারতব্যাপী যে- জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটিই হবে ঐ ছবির উপজীব্য। আমরা তখন টগবগে তরুণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কেবল ১৯৭২ সনে। আমাদের ঐ চলচ্চিত্রে আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। চলচ্চিত্রটি তাই দেখলাম- একবার নয়, দু’-দু’বার! কেন সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি।
আমি প্রথমেই বলে নিচ্ছি, আমি ঐ ছবিটির সমালোচনা কিংবা মূল্যায়ন করতে বসিনি; তার দুয়েকটি বিষয় নিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি মাত্র। ছবিটির উপশিরোনামে বায়োপিক কথাটি জুড়ে দেয়ার জন্য, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, জওহরলালের বিখ্যত ‘Tryst with destiny’- বক্তৃতার অংশবিশেষ এবং মৃতশয্যায় নেহরু, তারপরে এক সময় ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের অসন্তোষ দেখানো যেতেই পারে। সেটা বাস্তবানুগ।
কিন্তু আমার কথা অন্য বিষয় নিয়ে। আমরা জানি, ইতিহাসভিত্তিক গল্পোপন্যসাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণ নতুন কোনো বিষয় নয়। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে এমন শিল্পকর্ম হরহামেশাই হয়ে আসছে। তার অনেকগুলো মানোত্তীর্ণ এবং কালোত্তীর্ণও হয়েছে। আমরাও তা বুঝতে পারি, ঐতিহাসিক চরিত্রদের মুখ দিয় যেসব কথা বলানো হয়, তা নির্মাতা কিংবা সহকর্মী কথা বলার সময়, ঐ চরিত্রের পাশে বসে কোনো নোটবইয়ে টুকে রেখে পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন না, করতে পারেন না। এরপরে, চলচ্চিত্রটির মূল দুটো বিষয়ের দিকে নির্মাতা-পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।
মুক্তিযুদ্ধে ভারত নানাভাবে আমাদের সাহায্য করে এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভারতের বাস্তব ও কৌশলগত যে লাভ হয়েছে তা’ কি একেবারে কিছুই নয়? যাক, এবার প্রধান বিষয় দু’টোতো আসি। এক, মুক্তিযুদ্ধের সময় তীব্র দুটো ভীতি বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষদেরকেও সদাসন্ত্রস্ত করে রেখেছে। তার একটি ছিল, উত্তর সীমানায় চীনের হামলা। আর অন্যটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে ঢুকে, আমাদেরকে দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ করতে পারে। বাস্তব চোখের দেখা এবং তারই ভিত্তিতে যে ইতিহাস তা’ সাক্ষ্য দেয় যে এর কোনোটিই ঘটেনি!
স্বাধীনতার মাস কয়েক পরে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এলে তাকে এক বিপুল গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ভারতের জনগণ ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি জনসমক্ষে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে তখন আমাদের দেওয়ার মতো কিছু ছিল না বলে। তিনি স্রেফ ভালোবাসা দেয়ার কথা বলেছিলেন ঐ কবিতার লাইন দু’টোকে। আজও তা আমার মনে আছ। রীতি অনুযায়ী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে কিছু উপহারও দেয়া হয়েছিল। অতিথি সরকারপ্রধানকে এমনভাবে আপ্যায়ন করা সভ্য জগতের রীতি।
এবার ‘ইমারজেন্সি’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মণিকর্নিকা ফিল্মস-এর পরিচালক কী করেছেন, শুনবেন? ইচ্ছা করলে দেখতেও পারেন। শেখ মুজিবের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তাঁকে একদল রঙ-বেরঙের পোশাক পরা ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে নিয়ে নেচে-গেয়ে বলিয়েছেন ‘ইন্দিরা আমাদের মা’। আর যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে ঢুকে তীরের একেবারে কাছাকাছি এমনভাবে পৌঁছেছিল যে আমরা দু’পক্ষকেই খুব কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছিলাম! তারপর? সম্ভবত ভয়েই, সপ্তম নৌ-বহর পিছিয়ে চলে গেছে! আর আমরা বাংলাদেশ পেয়ে গেলাম! আমাদের দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে!
কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের বাস্তবিক ঐতিহাসিকভাবে অসত্য ও বানোয়াট একটি চিত্র এঁকেছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর ও অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ একটি চিত্র এই ছবির মাধ্যমে আঁকা হয়েছে। কূটনৈতিক ও অন্যান্য পন্থায় এর নিন্দা জানিয়ে ভারতের কাছে এর প্রতিবাদ জানানো উচিত। আমার আশঙ্কা তা’ করা হবে না! সেই কাজটি ঘোর মুজিববিরোধী হলেও করা উচিত, যদি বাংলাদেশের অপমানে আমরা অপমানিত বোধ করি!
লেখক : অনুবাদক ও সমালোচক