বাঙালির রাজনৈতিক চরিত্র বড়ই বিচিত্র

: রেজাউল করিম
প্রকাশ: ৫ দিন আগে
ছবি : রেজাউল করিম (লেখক)

আমরা কথায় কথায় বলি, বাঙালি বীরের জাতি। ইতিহাস ঘাটলে বাঙালি বীরের জাতি তার তেমন সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলে না। বাঙালির ইতিহাস করুণ ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস কাপুরুষতার ইতিহাস, ভীরুতার ইতিহাস, অবিমৃষ্যকারিতার ইতিহাস, অদূরদর্শিতার ইতিহাস, হতাশার ইতিহাস, পরাধীনতার ইতিহাস। বাঙালি যদি বীরের জাতি হয় তাহলে তারা কিভাবে শত শত বছর বা হাজার বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রইল? প্রত্যেক জাতির জীবনে জয়-পরাজয় আছে। তাই বলে কি শত বছর বা হাজার বছর পরাজয়?

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যতীত বাঙালির জয় তো দুরের কথা পরাজয়ের ইতিহাসও তেমন নেই। কেননা পরাজয় হতে হলেও তো যুদ্ধ করতে হয়। সেটা বাঙালি কতটুকু করেছে? ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বাংলা দখল করে ফেলল। বাংলার রাজা লক্ষণ সেন কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা না করে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেন। অথচ ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী ছিলো আফগানিস্তানের গরমশিরের বাসিন্দা এবং গাধা চালক। সেখানে তিনি গাধা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরে বহু কষ্টে তিনি কুতুবউদ্দিন আইবকের অধীনে সৈন্যদলে যোগ দেন। সুযোগ বুঝে তিনি বাংলা দখল করে রাজা বনে যান।

সুলতানি আমল, মুঘল আমল, বৃটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলে যারা বাংলা শাসন করেছে তারা কেউ বাঙালি ছিলেন না। বাংলার ইতিহাস যেন ধর্ষিতার ইতিহাস। বহু ব্যক্তি, বহু জাতি বাংলাকে শাসন করেছে, কিন্তু বাংলা কাউকে শাসন করতে পারেনি। অপর দেশ তো দূরের কথা বাংলা নিজেকে নিজে শাসন করতে পারেনি। বাংলার কেউ কি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার চেষ্টা করেনি, তা নয়। যারা করেছে, তাদের নাম কেউ জানে না বললেই চলে। তাদেরকে কেউ স্মরণ করে না, শ্রদ্ধা করে না। বরং যারা বাংলার স্বাধীনতা হরণ করেছে, বাংলাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে তারাই বাঙালির কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। বাঙালি তাদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এটা বাঙালির ইতিহাসে এক ট্রাজেডি, বড়ই দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয়। বাংলার ইতিহাসে যিনি প্রকাশ্যে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি হলেন ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ। তাঁর নাম কয়জনে জানে? বরং তাঁকে উপহাস করে বলা হতো ফখরা। অবশ্য তাঁর পূর্বেও দু’একজন বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। যেমন মুইযউদ্দিন তুঘরিল খান। তিনি ছিলেন বাংলার সহকারী গভর্নর। দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁকে সহকারী গভর্নর করে পাঠান। সুযোগ বুঝে তিনি ১২৭৯-১২৮০ সালে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিল্লির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পরে যুদ্ধে তুঘরিল খান দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের নিকট পরাজিত ও নিহত হন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের ছেলে বুগরা খান দিল্লির সুলতান না হয়ে বাংলার সুলতানের পদ বেছে নেন। তিনিও ১২৮৮ সালে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলা শাসন করতে থাকেন। অথচ তাঁদের নাম কেউ স্মরণ করে না। অবশ্য এঁরা স্বাধীন ছিলো সাময়িক সময়ের জন্য।

পূর্ব বাংলায় বারো ভূঁইয়ারা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন। এ বারো ভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ইসা খান। ইসা খানের পর তাঁর পুত্র মুসা খান। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বাদ জাগে বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার। এ জন্য তিনি প্রথমদিকে সেনাপতি মানসিংহকে বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করে এবং পরে সেনাপতি ইসলাম খাঁকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করে পাঠান। বারো ভূঁইয়াদের দমন করে পূর্ব বাংলাকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করার নির্দেশ দেন তিনি। বারো ভূঁইয়ারা বীরত্বের সঙ্গে মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। সুবাদার ইসলাম খাঁ পূর্ব বাংলা দখল করে ১৬১০ সালে সোনার গাঁও এর স্থলে ঢাকাকে বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী ঘোষণা করেন এবং ঢাকার নাম দেন ‘জাহাঙ্গীর নগর’। আমাদের অনেকে এখনো জিজ্ঞেসা করেন, ঢাকার অপর নাম কী? আমরা হর্ষচিত্তে উত্তর দেই- ‘জাহাঙ্গীর নগর’। বাংলায় সম্রাট জাহাঙ্গীরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পাকিস্তান সরকার ঢাকার অদূরে সাভারে ১৯৭০ সালে তার নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়’। অথচ সম্রাট জাহাঙ্গীর একজন দখলদার (occupier)। যে ব্যক্তি বাংলার স্বাধীনতা হরণ করে সে ব্যক্তির নামে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। জাহাঙ্গীর নিজে যদি নিজের নামে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করত সেটা মেনে নেওয়া যায়। বাঙালিরা কিভাবে একজন দখলদারের নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মেনে নেয় সেটাই প্রশ্ন। আর যে বারো ভূইয়ারা বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করল, তাঁদের নামে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করি না। তাঁদের নামও হয়তো জানি না।

বাংলার যে কয়েকজন সুবাদার বা নবাব বাংলা থেকে বেশি রাজস্ব আদায় করে দিল্লিতে প্রেরণ করেছেন তাঁরাই বাংলায় বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন- সুবাদার শায়েস্তা খান এবং নবাব মুর্শিদকুলি খান। তাঁরা দুজনেই বাংলা থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা (স্বর্ণ মুদ্রা) রাজস্ব হিসেবে দিল্লিতে পাঠিয়েছেন। সে টাকা দিয়ে দিল্লি-আগ্রাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। আওরঙ্গজেব যে সারাজীবন দাক্ষিনাত্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন সে যুদ্ধের খরচ যুগিয়েছে এ বাংলা। শায়েস্তা খান ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য করে ২২ বছরে ৩৮ কোটি টাকা বাংলা থেকে নিয়ে গেছেন। তাঁর সময়ে টাকায় আটমন চাল পাওয়া যেত। এর অর্থ এই নয় যে চাল খুব সস্তা ছিল। তখন টাকার খুব আকাল ছিল। আর ঐ টাকাটা ছিল স্বর্ণের। তখনকার ১ টাকা=১ ভরি স্বর্ণ, ২৪ ক্যারেটের বিশুদ্ধ স্বর্ণ। ঐ ১ ভরি স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য হিসাব করলে চালের দাম শায়েস্তা খানের সময়ের তুলনায় বর্তমানে কয়েকগুণ সস্তা।

যারা বাংলার টাকা চুষে নিয়ে গেছে এবং চুষে খেয়েছে তাঁরাই বাংলায় সমাদৃত হয়ে আছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরভর্তি তাঁদের নাম। যেমন- বাবর রোড, হুমায়ুন রোড, শাহজাহান রোড, নুরজাহান রোড, তাজমহল রোড ইত্যাদি। তাঁরা বাংলার কেউ নন। তাঁরা বাংলার শোষক। অথচ বাংলায় তাঁদের কী সম্মান! মুঘল বংশের সর্বশেষ্ঠ শাসক হলেন সম্রাট আকবর। তাঁর নামে কোনো স্থাপনা নেই। কারণ তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ।

বাঙালির আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বড়ই অভাব ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল শত শত বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা। এরা পরের মাথায় ছাতা ধরতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করত। এরা নিজেরা নেতৃত্ব দিতে পারেনি, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এরা অপরের নেতৃত্বের দিকে চেয়ে থাকত। ভিনদেশীর প্রতি এদের শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল অপরিসীম। সে মুসলিম হলেই হতো আর কথা নেই। বাঙালিরা ইচ্ছা করলে ১৯৪৭ সালেই বাংলাকে স্বাধীন করতে পারত। এরা বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র করতে না চেয়ে পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। অথচ পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেনি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচন ছিল মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নির্বাচন। সে নির্বাচনে বাংলার শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলমান মুসলিম লীগকে ভোট দেয়। আর পাকিস্তান অঞ্চলের শতকরা ৫০.০৮ ভাগ মুসলমান মুসলিম লীগকে ভোট দেয়। সে নির্বাচনে বাংলা ব্যতীত কোনো প্রদেশেই মুসলিম লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। শুধু বাংলায়ই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। মুসলিম লীগ আর কোথাও সরকার গঠন করতে পারেনি। পাঞ্জাবে খিজির হায়াত খান তেওয়ানার নেতৃত্বে ইউনিয়নিস্ট সরকার, সিন্ধুতে জনাব আল্লাহ বক্সের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ বিরোধী সরকার ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ডা. খান সাহেবের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। পশ্চিমারা কল্পনাও করেনি বাংলা পাকিস্তানের সাথে আসবে। তারা যদি কল্পনা করত বাংলা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করা হবে তাহলে পাকিস্তান নামের মধ্যে বাংলার B স্থান পেত বা বাংলার B সংযুক্ত করে কিভাবে নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের নামকরণ করা যায় তা নিয়ে ভাবত। ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী পাঞ্জাবের P, আফগানিস্তানের A, কাশ্মীরের K, সিন্ধুর S এবং বেলুচিস্তানের TAN নিয়ে পাকিস্তান নামকরণ করেন। সেখানে বাংলার B নেই।

সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎ বসু এরা যখন অখণ্ড স্বাধীন বাংলা দাবি করতে থাকল তখন মওলানা আকরাম খাঁ ও খাজা গ্রুপ যুক্ত বাংলার দাবি থেকে সরে আসেন এবং বাংলা বিভক্তির পক্ষে অবস্থান নেন। বাংলার গভর্নর ফ্রেডারিক বারোজও স্বাধীন যুক্ত বাংলার পক্ষে ছিলেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বিষয়টি সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোন থেকে দেখতেন। তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করতে রাজি ছিলেন না। তারপরেও তিনি বাংলার বিষয়টি জানতে বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠান। অবশেষে মাউন্ট ব্যাটেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমুহের আইনসভার প্রতিনিধিগণ ১৯৪৭ সালের ২০ জুন পৃথক পৃথক বৈঠকে বসেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহের প্রতিনিধিগণ ১০৬ : ৩৫ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহের প্রতিনিধিগণ ৫৮: ২১ ভোটে অখন্ড স্বাধীন বাংলার বিরুদ্ধে বাংলা বিভক্তির পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন।

পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিলো পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন। পাকিস্তানের বাকী চারটি প্রদেশের জনসংখ্যা মিলে ছিলো শতকরা ৪৪ জন। বাঙালিরা একবারও প্রশ্ন করল না পাকিস্তান সৃষ্টি হলে তার রাষ্ট্রভাষা কী হবে, রাজধানী কোথায় স্থাপিত হবে, দেশের শাসনতন্ত্র কী ধরনের হবে? প্রধান মন্ত্রী বা গভর্নর জেনারেল কোনো অঞ্চল থেকে হবে? বাঙালিরা তো দাবি করতে পারতো আমরা তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারি, তবে শর্ত আছে। আর তাহলো যেহেতু আমরা (বাঙালিরা) সংখ্যাগরিষ্ঠ সেহেতু রাজধানী পূর্ব বাংলায় করতে হবে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে? গভর্নর জেনারেল বা প্রধান মন্ত্রীর যে কোনো একটা পদ বাঙালিদেরকে দিতে হবে। দাবি পূরণ হওয়া পরের কথা বাঙালিদের মুখে এসব দাবি উচ্চারণ করতেও শোনা যায়নি। অথচ এসব দাবি ছিল ন্যায্য দাবি।

মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর ছয়দফাকে সমর্থন করেননি। তিনি ছিলেন ছয়দফা বিরোধী। তিনি ছয়দফা কর্সসূচির পাল্টা হিসেবে ১৪ দফা ঘোষণা করেন। কিন্তু তা হালে পানি পায়নি। জনগণ বঙ্গবন্ধুর ছয়দফাকে সমর্থন ও গ্রহণ করে। এমনকি ছয়দফা না হলে কি আগরতলা মামলা হতো? আগরতলা মামলা না হলে কি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান হতো? ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান না হলে কি আইয়ুব খানের পতন হতো? আইয়ুব খানের পতন না হলে কি ৭০ এর নির্বাচন হতো? ’৭০-এর নির্বাচন না হলে কি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হতো? ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ না হলে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হতো? এসব ঘটনা একটার সঙ্গে আরেকটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

বঙ্গবন্ধু যদি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বাংলার স্বাধীনতার কথা বলতেন, তাহলে এ দেশের মানুষ তাঁকে এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগকে এত ভোট দিত কিনা সন্দেহ ছিল। তিনি সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বলে এ দেশের মানুষকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পরও যখন পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না, তখনও তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন না। তিনি চেয়েছিলেন, আগে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করুক। তারপরে স্বাধীনতা ঘোষণা। পাকিস্তানিদের আক্রমণের আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাতে তিনি দেশের ভেতরের ও বাইরের শক্তির এত সমর্থন পেতেন না। তারা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে অভিহিত করতেন। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হতে চাননি। ভোটের পরে মানুষের শরীর ও মন উত্তপ্ত থাকে। মানুষ ভোট দিল, অথচ সে ভোটের ফল অনুযায়ী ক্ষমতা দিলো না, তারপরে আবার আক্রমণ- এটা অধিকাংশ মানুষ আর সহ্য করতে পারবে না, এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন। বঙ্গবন্ধু এটাও জানতেন, আলোচনা ফলপ্রসু হবে না। আক্রমণ তারা করবেই। পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করলে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে বাঙালিরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এবং ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স ও শান্তি কমিটির সদস্যও কম ছিল না। তখনো (১৯৭১ সালে) ২০% লোক মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছিল। এখনো তাদের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। এখন তারা নামে-বেনামে, ভিন্ন নামে বিভিন্ন দলে আছেন। এখনো দেশে ৩০%-৪০% লোক আছেন, যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। কারণ তিনি তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরেও জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি গোপনে ভুট্টোর সমর্থন লাভ করে এবং তারা ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। ভুট্টো মওলানা ভাসানীর নিকট এক বিশেষ দূত পাঠিয়ে ‘মুসলিম বাংলা’ গঠন করতে অনুরোধ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানী বলেন, “যারা ‘মুসলিম বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে আমি তাদের দোয়া করি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে।” স্বাধীনতার পর ভাসানী বের করলেন ‘হক কথা’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকার কাজ ছিলো আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী বক্তব্য প্রচার করা। এর যারা সম্পাদক, লেখক ছিলেন তারা সবাই ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিরোধী। এ দিকে সিরাজ শিকদার, আবদুল হক, আবদুল মতিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, দেবেন শিকদার, অমল সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন চীনপন্থি বাম গ্রুপের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন নয়, বাংলাদেশ ভারতের অধীন। তারা ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানান। মওলানা তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, “তিনি একটি স্বাধীন পূর্ব বঙ্গ প্রতিষ্ঠা করবেন যেখানে উড়বে একটি নতুন পতাকা।” এরপর তিনি ‘হুকুমতে রাব্বানী’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতে লাগলেন যার বক্তব্য ছিল আওয়ামী ও ভারত বিরোধী। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর সরকরকে হুমকি দিয়ে বলেন যে, ১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দালাল আইন বাতিল না করলে তিনি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবেন। তাঁর এসব কার্যকলাপ সামরিক ষড়যন্ত্র ও স্বাধীনতা বিরোধীদের উৎসাহিত করে। মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণ করলে তিনি তাকে সমর্থন ও দোয়া করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যদি পাকিস্তানের সাথে একীভুত হওয়ার জন্য গণভোটের আয়োজন হতো, তাহলে অধিকাংশ বাঙালি তাতে সায় দিত।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যদি অকার্যকর ও জঙ্গি রাষ্ট্র না হতো, উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতো, কিংবা বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর না হতে পারত, তাহলে এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকত না, কবর থেকে হাড় উঠিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিত। এখনো অনেকে আছেন যারা ঘুমানোর আগে বঙ্গবন্ধুকে দু‘টো গালি দিয়ে ঘুমান। ২০২৪’র জুলাই অভ্যুত্থানের পর শুধু গালিতেই তারা ক্ষান্ত নন, প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে হাতুরিপেটা করছেন। স্বাধীনতা স্মৃতিবিজড়িত তাঁর ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর নাম নিশানা মুছে ফেলা হচ্ছে। ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। বদলে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে ৭২’র সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত। এক সময় জাতীয় পতাকা ও বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা হবে না- তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এসবের সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িত। বঙ্গবন্ধুই পূর্ব পাকিস্তানের নাম রেখেছিলেন বাংলাদেশ। তাই তাঁর প্রতি এক শ্রেণির বাঙালির ক্ষোভ। যিনি সারাটা জীবন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, আরামের ঘুম হারাম করেছেন, আর তিনিই কিনা সপরিবারে এ বাঙালিদের হাতে নিহত হলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করলেন।

আর যে জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল, সেই পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলাম অস্তিত্বহীন। তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে বরং বাংলাদেশে। স্বাধীনতার বিরোধিতা করা, পরাধীনতা বাঙালির একটা ঐতিহ্য। কী বিচিত্র এ দেশ, এ দেশের মানুষ, এ দেশের রাজনীতি!

 লেখক : ইতিহাস বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
  • ইতিহাস
  • বাঙালি জাতি
  • #