জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের রয়েছে গৌরবদীপ্ত আইনি ঐতিহ্য (legal heritage)। ‘কে বলে তোর দরিদ্রঘর? হৃদয়ে তোর রতনরাশি!’ এর জ্বলজলে দৃষ্টান্ত আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্র সাংবিধানিক চরিত্রের। এতে রয়েছে বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠার শেকড়ের মূল্যবোধ ও চেতনা (foundational values and aspirations)। এরকম উদাহরণ রয়েছে আর শুধু আমেরিকার ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা ঘোষণার (American Declaration of Independence)। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের এ ধরনের ঘোষণা থাকলেও তা বাংলাদেশ ও আমেরিকার মানের নয়।
আমাদের ঘোষণাপত্রে লেখা আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক। সাড়ে সাতকোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এখানেই লেখা আছে, আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা করেছি, মানুষের জন্য ‘সমতা, মানব মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য’। কল্পনায় ধরি, বাংলাদেশের আর কোন আইনি দলিল যদি কাল থেকে নাও থাকে, তবুও এই স্বাধীনতার ঘোষণা ‘আলোকময় জ্যোতিষ্ক’ হিসেবে বাংলাদেশকে আরো শতবর্ষ পথ দেখাতে পারবে।
দুঃখের বিষয় আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে জানিনি। পড়িনি। যত্ন করিনি। যতদূর জেনেছি, জেনারেল জিয়ার সময়ে হাতে লেখা মূল ঘোষণাটি হারিয়ে যায়। কি দুর্ভাগা জাতি আমরা! জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর ফুরসৎ তৈরী করে দিতে এই ঘোষণাপত্র কখনও মানুষকে পড়তে দেয়নি সামরিক বা প্রায়-সামরিক সরকারগুলো। প্রবণতাটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেয়া। ১৯৭৫-এ জাতির জনককে হত্যার পর এভাবে চলেছে একুশ বছর।
১২ জুন ১৯৯৬। এক ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়। আইনমন্ত্রী ছিলেন আব্দুল মতিন খসরু। যাতে এটি হারিয়ে না যায়, নজরের মধ্যেই থাকে যেন, যাতে আমাদের বিচারিকবোধে এটি প্রাসঙ্গিক থাকে- সেজন্যই এ সংযোজন।
আপনিই বলুন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংরক্ষণ করা কি শুধু শেখ হাসিনার দায়িত্ব? ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে এই ঘোষণাপত্রকে সংবিধান থেকে আবার বাদ দিয়ে দেয়। এ সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। কী বুঝলেন?
এরপরে, আওয়ামীলীগ ২০০৯ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসে, আবার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এবং দেশের জন্য মায়া ও দরদ না থাকলে এগুলো করা সম্ভব নয়। এগুলো এমনি এমনি হয় না।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সবচেয়ে বড় অপমানের শিকার হয় ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট। শহীদ মিনারে স্বভাব বিরুদ্ধ ‘ধন-ধান্য’ গেয়ে আমাদের ‘নব্যবিপ্লবীরা’এক হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে মিমিক্রি ও মকারি করে এক ঘোষণাপত্র পাঠ করে। ওই ভাষা শুনে আমার মনে হয়েছিল এখানে আসিফ নজরুল-শহীদুল আলম সম্প্রদায়ের আশকারা আছে। অবশ্য এটি কোনো জামাতি মাথা থেকেও আসতে পারে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, এসব বিপ্লবীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও চিন্তার ধারা- ঐ একই ইতিহাস বিকৃতি, এবঙ বাঙালিকে মূল্যবোধগতভাবে লুলো-ভিখিরির জাতিতে পরিণত করা। তারা বাংলাদেশকে হারিয়ে দিতে চায়। পুরানো প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস তো অবিনশ্বর ও অমলিন! যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রণীত (১৭ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পঠিত ও গৃহীত) ঘোষণাপত্রের কাছে ফিরে যাব।
২০১০ সালে আমি ব্যারিস্টার আমীর -ঊল ইসলামের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেটি ডেইলি স্টার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। মাঝে মাঝে, তাঁকেই আমার বাংলাদেশের সেরা কনস্টিটিউশনাল জুরিস্ট মনে হয়। এমনকি ড. কামাল থেকেও। বয়সে এখন স্যারের স্মৃতিশক্তিতে চিড় ধরেছে। যাই হোক, সেই সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার ইসলাম অন্যান্য অনেক কথার মধ্যে এই কথাটি আমাকে বলেছিলেন- ‘এর [স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের] উচ্চারণ যেন শতাব্দীর সাধনা, প্রজন্মের স্বপ্ন আর সংগ্রামের নিঃশব্দ আর্তনাদ থেকে উঠে আসা জাতির সমবেত মননের ধ্বনি… এটি সেই বিরল ইতিহাসের ক্ষণ, যখন মানুষ নিজ সত্তার সীমা পেরিয়ে জাতির আত্মায় বিলীন হয়— যেখানে আলাদা শরীর নয়, এক অভিন্ন চেতনায় কথা বলে। এই সম্মিলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় একটি জাতি, একটি দেশ, একটি রাষ্ট্র— বিশ্বসভায় তার স্থান করে নিতে, যেন আমরা স্বাধীনতা সত্তায় বিকশিত হতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষা সাতে সঙ্গতি রাখিয়া বিশ্ব শান্তি ও সহযোগিতায় পূর্ণ অবদান রাখতে পারি।’
এবারে আমি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু আইনি বিশ্লেষণ দিচ্ছি। আমি এটি আগেও যত্ন নিয়ে লিখেছি। এখানে আবার নতুন করে মন দিয়ে লিখছি এই জন্য যে, এটি আমাদের বুঝিয়ে দেবে আমাদের জাতিত্বের আইনি শক্তি।
১৮২৬ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের নাগরিকরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৫০ বছরপূর্তি পালন করছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল ঘোষণাপত্রটির প্রণেতা থমাস জেফারসনের। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারেননি। তবে আয়োজক রজার ওয়েটম্যানকে একটি চিঠি ল্যাখেন। চিঠিতে জেফারসন বলেন- ‘এই ঘোষণাপত্র হোক সার্বজনীন। আমি বিশ্বাস করি, আজ নয়তো আগামীকাল, এটি বিশ্বব্যাপী শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষের হৃদয়ে সাড়া দেবে—তাদের জাগিয়ে তুলবে যারা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত। আমি কামনা করি, প্রতিটি জাতি যেন নিজেদের জন্য ন্যায্য শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তার সুফল ভোগ করতে পারে।’ আসেন এটাকে আমরা বলি জেফারসনিয়ান সেজ।
কে জানত, এই চিঠি লেখার দেড় শতাব্দী পরে এক ভিন্ন মহাদেশের এক ভিন্ন জাতি—‘বাঙালি’ নামের একটি জনগোষ্ঠী—তাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই ঘোষণার প্রতিধ্বনি তুলবে? ব্যারিস্টার আমীর-ঊল ইসলাম লিখবেন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মঘোষণা, তাজউদ্দীন আহমদ সেই মন্ত্র উচ্চারণে এনে দেবেন বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ের গান, আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম রূপরেখা দেবেন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্নের। জেফারসন-মেডিসন থেকে থেকে আমাদের পার্থক্য হল, আমাদের সংবিধান দিশারিরা ছিলেন আরো শেকড়ের মানুষ, মাটির কাছের, এবঙ সাধারণ্যের। তাঁরা ছিলেন মাথায় গামছা বাঁধা, পকেটে চিরুনি কাঁকই রাখা জনমানুষের নেতা।
ঠিক কী কারণে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এত স্বতন্ত্র? কী জন্যে এটি স্বাধীনতা অম্লান সূর্যমুখী? দু’টো কারণে- একটি হলো, এটি আমাদের, মানে বাঙালির প্রথম ও শাশ্বত সংবিধান। দ্বিতীয়ত, এটি আন্তর্জাতিক আইন (international law) ও বৈশ্বিক সাংবিধানিক আইনের (global constitutional law) কতকগুলো অসাধারণ দিক তুলে ধরে। এভাবে এটি তৃতীয় বিশ্বের আন্তর্জাতিক আইনি দৃষ্টিভঙ্গি বাতলে দেয়।
সাংবিধানিক পয়েন্টে অনেক কথা লেখা যাবে। শুধু এটুকুই এখানে বলার যে, এই ঘোষণাপত্রটি আমাদের লিখিত সাংবিধানিকতার গোড়াপত্তন করে। বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী অষ্টম সংশোধনী মামলায় (১৯৮৯) এটিকে বলেছেন, ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ কনস্টিটিউশন’। বিচারপতি খায়রুল হক একই কথা প্রতিধ্বনিত করেছেন স্বাধীনতা ঘোষণা মামলায় (২০০৯)। ড. কামাল আমাদের সংবিধান বানানিতে কেসি হয়ার থেকে প্রেরণা নিয়েছিলেন। কেসি হয়ার স্বজাত সংবিধানের ধারণার প্রবর্তক। আমাদের সংবিধানের অতোকথোনি বা স্বজাত্যর (autochthonous) দর্শন এভাবেই এসেছে।
এখন ভেবে দেখুন, এই যে মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক ভাবনা, তা বাদ দিলে আপনি কি আর এই দেশ হিসেবে থাকবেন? এই জুরিসপ্রুডেন্স বাদ দিয়ে, আপনি এ দেশে বিচার করবেন? রাজনীতি করবেন? ২০৪১ বা ২০৫০ বা ২০৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশকে টেকসই করতে পারবেন? পারবেন না। এটা বাদ দিলে দেশ হয়ে যাবে সোললেস।
আর এজন্যই, স্বাধীনতার ঘোষণা অমোঘ (sacrosant) ও অলঙ্ঘনীয় (inviolable)। এবারে আসেন, আন্তর্জাতিক আইনের তাৎপর্যের দিকে। এই দিকটা নিম্নোক্ত ৩ টি বিষয় সামনে এনে উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা করা যায়- এক. একপাক্ষিক স্বাধীনতা ঘোষণা; দুই. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার; এবং তিন. রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
প্রথমে আসি একপাক্ষিক ঘোষণা বিষয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনেক বিদেশি পণ্ডিত ইউডিআই (Unilateral Declaration of Independence)-এর ক্লাসিক্যাল উদাহরণ হিসেবে দ্যাখেন। আন্তর্জাতিক আইনে ইউডিআই একটি আলোচিত ধারণা। তবে এটিকে সরাসরি বিতর্কিত বলা যায় না (রফিকুল ইসলাম, ১৯৮৩)। এর বৈধতা নির্ভর করে পরিস্থিতি, ঘোষণাকারী এবং বাস্তবতায় রূপদানের উপর।
বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কৌশলে নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। ৩ মার্চ ১৯৭১, ইকবাল বাহার চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী (২০০৭), বঙ্গবন্ধু রাতে বলেছিলেন, ‘ইউডিআই করব।’ তবে তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিলে আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দমন করা যেতো। তাঁর কৌশলী প্রতিক্রিয়া ছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন হারানোর সম্ভাবনা বিবেচনা করেই।
৭ মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘নব্য উপনিবেশ’ পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ঝাঁঝালো প্রকাশ ঘটান। তাঁর গলায় বাঙালির শতবছরের বঞ্চনা উঠে আসে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলকভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে, এর বিরুদ্ধে ২৬ মার্চ তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল আইনি ও নৈতিকভাবে যথার্থ।
অনেক আইনবেত্তা ল্যাখেন, পূর্ব পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আইন মানদণ্ডে উপনিবেশ ছিল না (বাহরুজ বেলায়েভ, ২০১৩)। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইন বলে, ইউডিআই-এর বৈধতা নির্ধারিত হয় তার সাফল্যের মাধ্যমে। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত কসোভো উপদেশ মামলায় ইউডিআই-কে বৈধ ঘোষণা করে। সেখানে প্রশ্ন ছিল—কসোভোর নেতৃত্ব তা ঘোষণার আইনি ক্ষমতা রাখে কি না। রাখে। তাই বলা যায়, পাকিস্তান যদি এমন মামলা তখনই বিশ্ব আদালতে করতো, তাহলে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণার আইনি বৈধতা সেখানে টিকতই।
ফুটনোটে পাঠককে বলে রাখি, এ নিয়ে, কসোভো উপদেশ মামলার অন্যতম জাজ স্যার কেনেথ কিথের সাথে এ নিয়ে আমি গল্প করেছি। আমি তখন নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটনে পিএইচডি করছি (২০১৩-২০১৮)। স্যার কিথ বসতেন আমার পাশের রুমে। তিনি বাংলাদেশের এই ইতিহাসের এই দিকটি শুনে মুগ্ধ হতেন।
এবার আসি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রশ্নে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দুটি যমজ দলিল আছে। ১৯৬৬ সালে গৃহীত — নাম আইসিসিপিআর ও আইসিইএসসিআর। এই দুই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ একটি মৌলিক সামষ্টিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত আছে। ১৯৬৬-এর পরে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যে এই অধিকারের চমৎকার দেশীয় প্রয়োগ করেছে। ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই দুটি মানবাধিকার দলিল অনুসমর্থন (ratify) করেন। চুক্তি অনুসমর্থন করার রাজনৈতিক ও আইনি মানস সব রাষ্ট্রনেতার থাকে না। এমনকি যে আইন বলে জামাতিরা শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিতে চায়, সেই আইসিসি বা রোম স্টাটিউটও ২০১০ সালে অনুসমর্থন করে রেখেছেন শেখ হাসিনা।
যা-ই হোক, ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা লিখেছি- ‘বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তাদের ন্যায্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার যথাযথ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের এই আর্গুমেন্টটি আমাকে দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার এম. আমীর-ঊল ইসলাম। তিনি ১৯৬৬ সালে ওই দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল প্রণয়নে লর্ড ফেনার ব্রকওয়ের সাথে কন্সাল্ট্যাটেটিভ পর্যায়ে কাজ করেছিলেন।
সুব্রত রায় চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Genesis of Bangladesh (এশিয়া, ১৯৭২)-এ বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে শক্ত আইনি যুক্তি দিয়েছেন। এই বইটি ইউরোপে এখনো আকাঙ্ক্ষিত পাঠ্য। আমাকে বইটির বাংলা অনুবাদ করার জন্য অরিজিনাল একটা কপি দিয়েছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। আমি অবশ্য বাংলা অনুবাদের কাজটি করতে পারিনি। তার আগেই জেয়াদ আল মালুম মারা যান।
বইটি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস-এর বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদনের পাল্টা জবাব হিসেবে কাজ করে। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনজীবী মাইকেল রেইসমান এই বইয়ের পর্যালোচনায় সুব্রত চৌধুরীর বিশ্লেষণকে সমর্থন করেন। ম্যাকডুগাল ও রেইসম্যান (১৯৬৮) মানব মর্যাদা সুরক্ষা যুক্তির ভিত্তিতে তাদের নিউ হ্যাভেন তত্ত্বে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছেন। আপনি আইয়্যান ব্রাউনলির লেখাকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে টানতে পারবেন। ২০১২ সালে অন্য এক অধ্যাপক বেনভেনিস্তি তাঁর বইয়ে মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের ঘোষণা ‘ন্যায়সম্মত ও ব্যাপকভাবে গৃহীত’।
এখন আসুন দেশের স্বীকৃতি প্রশ্নে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যতটা আত্মপ্রত্যয়ের দলিল, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ততটাই রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের বাস্তব-ভিত্তিক। কসোভো উপদেশ মামলার শুনানিতে জেমস ক্রফোর্ড মজার একটা কথা বলেছিলেন- ‘কোনো দেশের মানুষদের স্বাধীনতার ঘোষণা হলো কিছু শব্দসমষ্টিকে বাতাসের কানে ছেড়ে দেয়ার মতো এবং অনেকটা একহাতে তালি বাজানোর মতো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে তাতে সাড়া দেয় সেটিই মুখ্য।’
বঙ্গবন্ধুর সহচর তাজউদ্দীন আহমদ এ সত্যটি গভীরভাবে সেই সময়েই উপলব্ধি করেছিলেন। মুজিবনগরে দাঁড়িয়ে ১৭ এপ্রিল তিনি বলেন- ‘আমরা চাই প্রতিটি জাতির বন্ধুত্ব … কোনো শক্তি বা সামরিক জোটের অধীনে নয়… আমাদের রক্ত কোনো তাবেদারির জন্য ঢালা হয়নি।’ এই বক্তব্যে একদিকে আত্মনির্ভরতার দৃঢ়তা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতার আবেদন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের প্রাক্কালে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় তিনটি আইনি যুক্তি দেন (সুব্রত চৌধুরী, ১৯৭২) এক. কার্যকারিতার পরীক্ষা (Effective control test): ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কার্যকর নেতৃত্ব; দুই. জনগণের ইচ্ছা (Jeffersonian principle): জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার; তিন. সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুভব (Feeling at par with): পাকিস্তানের আগ্রাসনে ভারত নিজেও আক্রান্ত মনে করে। এই যুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আইনে এক নবসংযোজন ছিল যা বাংলাদেশের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ স্বীকৃতি আইনের দক্ষিণ এশিয়ান নীতি প্রকাশ করে। আর এর ভিত্তি হল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
এখন, আপনি আমাকে বলুন, আমাদের ইতিহাসের এই যে শক্ত শেকড়, এই যে বিনুনি, এই যে ঐতিহাসিকতা, এই যে দৃষ্টিভঙি, এই যে আন্তর্জাতিক মনন- এসব আমাদের ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে আইনের ছাত্ররা কেন জানবে না? কেন তারা এগুলো খতিয়ে পড়বেনা, এবং ধারণ করবেনা? এসব বাদ দিয়ে একটা দেশ হবে? এরা কেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ছোট করবে? এসব দেখে আইনের শিক্ষক হিসেবে প্রবল অভিমানে মাঝে মাঝে আত্মাহুতি দিতে ইচ্ছে করে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ঠিক তারই প্রতিসংহার ঘটে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়া আম্রকাননে। একটি আম বাগানের নিচে দাঁড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে শপথ নেয়া সেই সরকার—যার বংশীবাদক ছিলেন বাঙালি জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু— তখন এক জাতির বহু কাঙ্ক্ষিত মুক্তির সূর্যোদয় ঘটে। ব্যারিস্টার আমীর কে শুভেচ্ছা। তিনি শতায়ূ হোন। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে কুর্নিশ ও সালাম। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অম্লান হোক। অশুভ শক্তি নিপাত যাক।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভিজিটিং ফেলো কোট দ্য জুর ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্স