মাওলানা রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

: অ্যাড. মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম
প্রকাশ: ২ দিন আগে

আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ, গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইনের সুশাসন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, জানমালের নিরাপত্তা বিধান, ধর্মপালনের স্বাধীনতা, নিজস্ব সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-বিশ্বাসের অবারিত চর্চা নিশ্চিত করার জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সরকার কাজ করবে- এমন প্রত্যাশা ছিল দেশের শান্তিকামী জনগণের। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানেও ন্যায়বিচার, সুশাসন ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে আন্দোলন করতে হচ্ছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন স্থানে মব সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ৭০টিরও অধিক আল্লাহর অলির মাজার শরীফ ভাঙচুর ও হামলা করেছে। অসংখ্য মসজিদের ইমাম-খতিব ও কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষককে হেনস্তা করে চাকুরিচ্যুত করেছে। এভাবে মব জাস্টিসের শিকার হতে হয়েছে ও বর্তমানেও হতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। সরকার বা প্রশাসন মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অথচ, রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার আছে। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধার সরকারকেই করতে হয়। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা ও সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

বিচারবহির্ভূত হত্যার যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় দেশে মব ভায়োলেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে। মাওলানা রইস উদ্দিন এর জ্বলন্ত উদাহরণ। গত ২৭ এপ্রিল দুই মাস আগের একটি অভিযোগের ভিত্তিতে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে গাজীপুরে তাকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের পর সকাল ১০টায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলে তাঁকে মৌলিক অধিকার হিসেবে খাদ্য ও চিকিৎসা কিছুই প্রদান করা হয়নি। ২৮ এপ্রিল ভোর চারটায় কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অথচ, এ হত্যাকাণ্ড ও মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে ইমাম রইস উদ্দীনকে অপরাধী বানাতে পুলিশের অপচেষ্টার কমতি ছিল না। যদিও রইস উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মনগড়া, মিথ্যা, তা ঘটনার পরিক্রমায় যেকোন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবে।

সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায় যে, গাজীপুর আখলাদুল জামে মসজিদে কমিটির মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ রয়েছে। মসজিদ কমিটির দ্বন্দ্বের জেরে তাকে নির্মম খুন করা হয়েছে- বলেছেন মসজিদটির মোতোয়াল্লি। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাও সাজানো বলে তিনি অভিহিত করেছেন। ঢাকায় ফিলিস্তিন ইস্যুতে সুন্নি মহাসমাবেশে মুসল্লিদের নিয়ে অংশ নেওয়ায় বিপরীত পক্ষ কথিত দুই মাস পূর্বের অভিযোগ এনে কমিটির কোন্দলে বলি হতে হলো ইমাম সাহেবকে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, পরবর্তীতে পুলিশের ভূমিকা ছিল মব সৃষ্টিকারীদের পক্ষে। পুলিশ কর্তৃক ইমাম সাহেবকে গ্রেপ্তার, ৬ ঘন্টা পর মামলা করে কোর্টের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ। এ দীর্ঘ সময়ে তাকে চিকিৎসা সেবা, খাবার খেতে ও পানি পান করতে না দেওয়া এবং ফলশ্রুতিতে বিনা-চিকিৎসা ও অনাহারে মাওলানা রইসের মৃত্যু। যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় বটে। মৃত্যু পরবর্তী দৃশ্যপট আরো করুন, পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে চাইলে না নেওয়া, তাঁর মৃত্যুর ৩ দিন পর তথাকথিত ঘটনার ২ মাস পর জব্ধ নাটকের মাধ্যমে মবসৃষ্টিকারীদের নিয়ে রইসের চরিত্রহননের অপচেষ্টা, কথিত ৫ জন ভিকটিমের ২২ ধারা গ্রহণ ও বিশেষত গাজীপুরের উপপুলিশ কমিশনার কর্তৃক ৩০ এপ্রিল দিবাগত মধ্যরাতে সন্দেহজনক সংবাদ সম্মেলনে ইমাম রইসকে দোষী প্রমাণে অপচেষ্টা প্রভৃতি ঘটনা পরম্পরায় দৃশ্যমান একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে দেশবাসী আহত ও ক্ষুদ্ধ হয়েছে।

মাওলানা রইস উদ্দিন সুফিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতপন্থি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য ও ঢাকা মহানগরীর সাবেক সভাপতি ছিলেন। তার সংগঠনের পক্ষ থেকে সারাদেশে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অবরোধ প্রভৃতি আন্দোলনের কারণে গাজীপুরের পুবাইল থানা মামলা গ্রহণ করেছে। তার সাংগঠনিক পরিচিতি থাকায় এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। বিগত ৩০ এপ্রিল এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে ১০২ বিশিষ্ট নাগরিকও বিবৃতি দিয়েছে। তারা বিবৃতিতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিতের দাবি জানান। পাশাপাশি এ মামলার তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে মব ভায়োলেন্স নামে রাহাজানি এবং নির্মম পুলিশি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।

তবে সবার মনে একটাই প্রশ্ন- বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ফসল এ সরকারের নিকট কেন ন্যায় বিচারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে দাবি আদায় করতে হবে? এ অন্তবর্তীকালীন সরকার ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। আইন বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবীমহল মনে করেন, সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক পরিচয়হীন যে কেউ মব ভায়োলেন্সের শিকার হলে রাষ্ট্র কী তাহলে মামলা নেবে না? তাদের প্রশ্ন, মাওলানা রইস উদ্দিন যদি অপরাধ করেও থাকে, তাহলে তাকে কি নির্যাতন করে হত্যা করা দেশের আইন-আদালত বৈধতা দেয়? বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বর্তমান মব ভায়োলেন্স দেশে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।

সরকার বা প্রশাসন যত তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবেন ততই দেশের জন্য মঙ্গল। কিন্তু, লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, পুলিশ প্রশাসন ফ্যাসিস্ট আমলের মতো আচরণ করেছে। ইমাম রইস হত্যার বিচার দাবিকারী জনতার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে লাঠিচার্জ, টিয়ারসেল নিক্ষেপসহ হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলায় চট্টগ্রামে ২১ জন ও গাজীপুরে ৫ জন ছাত্রজনতাকে গ্রেপ্তার করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশবাহিনীর সঙ্গে হেলমেট ও লাঠিয়াল বাহিনী হামলা করত, এবার পুলিশের সঙ্গে নব্যসন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা চট্টগ্রামের মুরাদপুর, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়াসহ কয়েকটি স্থানে পরিলক্ষিত হয়েছে। নতুন এ হেলমেট ও লাঠিয়াল বাহিনী পুলিশের ছত্রছায়ায় নয়ানৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দেশে সংস্কার ক্ষেত্রে এসব বিষয় প্রথমেই গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য অস্ত্রধারণকারীদের অদ্যাবধি আইনের আওতায় না আনা দুঃখজনক ও কলঙ্কজনক বটে।

জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ‘মব’ ও ‘মব জাস্টিস’ শব্দগুলো নতুন করে আলোচনায়। দেশে বেশকিছু মব জাস্টিসের ঘটনা এরই মধ্যে ঘটেছে। মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছে নারী-শিশু, ছাত্র, পুলিশ, শিক্ষক, ইমাম-খতিব থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মব জাস্টিস থেকে রক্ষা পায়নি বিদেশিরাও। বিভিন্ন সময়ে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনি, সংঘবদ্ধভাবে হামলা; এভাবে প্রতিনিয়ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দলবদ্ধ পিটুনিতে নিহত হয় ২১ জন। ফেব্রুয়ারিতে মবের শিকার হয়ে মৃত্যু হয় সাতজনের। আর মার্চের প্রথম ৪ দিনেই মব জাস্টিসের নামে মারা যান দুজন। আর গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গণপিটুনিতে ১২১ জন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, মব জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার, তাঁকে যেন নিরপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে।

৫ আগস্টের দেশের পট পরিবর্তনের পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যখন সবার চোখে মুখে, তখন মব জাস্টিসের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসমূহ বৈষম্য মুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে ধ্বংস করবে। সরকার ও প্রশাসনের উচিত, এ মুহূর্তে নিশ্চিত করা যে, ইমাম রইস উদ্দিন হত্যায় হোক দেশে সর্বশেষ মব জাস্টিস।

তাই ইমাম রইস নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের ভিডিও ফুটেজ, ছবি দেখে সনাক্তপূর্বক গ্রেপ্তার ও দায়িত্ব অবহেলার দায়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। রইস উদ্দিন হত্যার বিভিন্ন দৃশ্যপটে পুলিশের ভূমিকা অপরাধীদের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই পুলিশ তদন্ত করলে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা সত্য উদঘাটন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইসাথে অনস্বীকার্য যে, বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। অন্তর্বতী সরকার যে এ বিষয়ে আন্তরিক তা প্রমাণ করাও সরকারে দায়িত্ব।

লেখক : অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, চট্টগ্রাম

  • ইমাম রইস উদ্দিন
  • সুবিচার
  • হত্যাকাণ্ড
  • #