নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা : সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি

:
প্রকাশ: ১ দিন আগে

‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ থেকে ঘোষণাপত্রে সহিংসতা ও বৈষম্যের অপচেষ্টা বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে নারীদের অধিকারসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী করার দাবি জানানো হয়। শুক্রবার (১৬ মে) বিকেলে ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ থেকে এ ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে কর্মসূচিতে পাঠ করা ঘোষণাপত্রে এই দাবি জানানো হয়।

ঘোষণাপত্রে বেশ কয়েকটি দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হল-

এক. অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

দুই. যারা আমাদের সমর্থন চায় নির্বাচনী অঙ্গীকারের মাধ্যমে হোক বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোক। তাদের স্পষ্ট করতে হবে নারী, শ্রমিক, জাতি, ধর্ম, ভাষা ও লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং এসব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়ে তাদের অবস্থান কী। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থীদের অন্তত শতকরা ৩৩ ভাগ (ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে) নারী হতে হবে।

তিন. নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আমাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা আমরা মেনে নেবো না। আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র আমরা প্রতিরোধ করবো। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে দমনমূলক অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা আমরা প্রতিরোধ করব। ইতিহাস বিচ্ছিন্ন কূপমণ্ডুকতার মাধ্যমে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে আমরা কিছুতেই সফল হতে দেবো না। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটি কয়েক মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সার্বজনীন হতে দেবো না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেবো না, মর্যাদা নিয়ে কোনো ধরনের দ্ব্যর্থকতা মেনে নেবো না। আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারী বিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখবো। যে ক্ষমতা কাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙবো।

আরও বলা হয়, আমরা চুপ করবো না, হুমকির মুখে নত হবো না। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থাকবো। ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা হাল ছাড়বো না। আজ যারা আমাদের সঙ্গে রয়েছেন তাদের ধন্যবাদ। আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়, কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ অগ্রযাত্রায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও তারা বাধা তৈরি করছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা এবং অনলাইনে হয়রানি করে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করার তৎপরতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলা, আন্দোলনে বাধা, পরিকল্পিত মব আক্রমণ, মোরাল পুলিশিং, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, প্রকাশ্যে মারধর এবং নানান ধরনের হুমকি প্রদান অব্যাহত রয়েছে।

ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, সম্প্রতি নারী অধিকার সংক্রান্ত সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক গঠিত অন্যান্য কমিশনের মতোই এ কমিশনটি গঠিত হয়েছিল। এ কমিশন শ্রমজীবী নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। অন্যান্য সব কমিশনের মতোই এ কমিশনের সুপারিশেও ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনার উপাদান। কিন্তু আমরা দেখেছি রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকেই অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সুপারিশগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে এবং গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ না রেখে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দেশবাসীর সামনে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। জনসম্মুখে কমিশনের সদস্যদেরকে জঘন্যভাবে অপমান করা হয়েছে।

এই কর্মসূচিতে প্রগতিশীল নারী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিককর্মী, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। বিভিন্ন সংগঠন এই কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, নারীমুক্তি কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, আদিবাসী ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ নারী জোট, নারী সংহতি, ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), তীরন্দাজ, শ্রমিক অধিকার আন্দোলন প্রভৃতি।

ঘোষণাপত্র পাঠ করা শেষে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’র একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে ইন্দিরা রোড ঘুরে আবারও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ফিরে আসে। মিছিলটি রাজধানী উচ্চবিদ্যালয় থেকে সেচ ভবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ সময় মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘পাহাড় থেকে সমতলে/লড়াই হবে সমান তালে’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই/লড়াই করে বাঁচতে চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।

  • নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা
  • সহিংসতা-বৈষম্য
  • হুঁশিয়ারি
  • #