জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিসংঘের করিডোর দেওয়া নিয়ে যে ইস্যুটা উঠেছে, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিচ্ছি, করিডর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারও কোনও কথা হয়নি, কারও সঙ্গে কথা হবে না। বুধবার (২১ মে) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, করিডোরের বিষয়টা বুঝতে হবে। এটা হচ্ছে একটা ইমারজেন্সি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে কাউকে সরাচ্ছি না। যেহেতু আরাকানে সাহায্য-সহযোগিতা অন্যান্য সাপ্লাই রুট দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না, জাতিসংঘ আমাদের এটুকুই বললো যে কাছেই যেহেতু বর্ডার, তাদের সাহায্য করতে, যাতে ত্রাণগুলো ওপারে নিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘ রাখাইনে তার নিজস্ব সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছাবে। আপনারা জাতিসংঘকে জিজ্ঞেস করেন, প্রমাণ পাবেন। আমরা করিডর নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও ধরনের কথা বলি নাই এবং বলব না। আরাকানের যে অবস্থা তাতে করিডরের কোনও প্রয়োজন নাই।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের ওপর কারও চাপ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ যারাই আছেন অংশীজন, আমরা সবার সঙ্গে কথা বলছি। তাড়াহুড়োর কোনও কথা নেই। হিসাব আমাদের সোজা, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে এবং ফেরত গিয়ে আবার যেন ফেরত না চলে আসে। টেকসই প্রত্যাবাসন হতে হবে।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা করিডোর শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন, করেই কিন্তু বলেছেন ‘পাথওয়ে’। সেটা স্লিপ অব টাং ছিল। কথাবার্তা অনেক সময় স্লিপ হতে পারে, কিন্তু উনি কারেক্ট করেছিলেন। উনি সেই কথা আর কখনোই বলেননি।
ত্রাণ রাখাইনে নিয়ে যাওয়ার পরে ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, এই প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, পুরো কন্ট্রোল থাকবে জাতিসংঘের, ওপারে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানকার নিরাপত্তা, সবকিছু তাদের দায়িত্ব। আমাদের দায়িত্ব সীমান্ত পর্যন্ত, সেখানে মাদকপাচার হচ্ছে কিনা, অন্য কিছু হচ্ছে কিনা, সেটা আমরা দেখবো। দুই পক্ষ সম্মত হলে, কনফ্লিট কমলেই শুধু আমরা যাবো।
ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ দেওয়া হলে কোন রুটে সেটা হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই পক্ষ, সব পক্ষ যদি রাজি হয়, তাহলে আমরা সবার সঙ্গে বসে সেটা ঠিক করবো। এটা কেবল সরকারের নয়, সব অংশীজনের সঙ্গে বসে আমরা সেটা ঠিক করবো। এখনও সেই পর্যায়ে আমরা যাইনি।
করিডর ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনও মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনও মতপার্থক্য নেই। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে আমরা এক সমতলে অবস্থান করছি। এ নিয়ে কোনও ফাঁকফোকর নেই।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার সুযোগ নেই। আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।
ড. খলিলুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তারপর থেকে এই ইস্যুটিকে আমরা আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় পুনরায় তুলে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এর আগে সাত বছর এই ইস্যুটি প্রায় অপসৃত হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক গাজা এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রোহিঙ্গা ইস্যু আরও পেছনে পড়ে গিয়েছিল। আপনাদের হয়তো মনে আছে, গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করেছিলেন এবং জাতিসংঘকে এই ইস্যুতে একটি সম্মেলন আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, যতদিন আরাকান অস্থিতিশীল থাকবে আমরা প্রত্যাবাসনের কথা বলতেই পারবো না। আর তাহলে তো প্রত্যাবাসন কৌশল নিয়েও কথা বলতে পারবো না। অনেকেই বলছেন করিডর নিয়ে আলাপ করছেন, আমাদের জানান নাই। অস্তিত্ববিহীন জিনিস নিয়ে কী করে আলাপ করবো, যার অস্তিত্ব নাই সেই বিষয়ে আলাপ কী করে হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া কী হবে, সেটা দেখতে গিয়ে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি সেটা হচ্ছে মিয়ানমার সরকারের দখলে ৯০ ভাগ রাখাইন নেই। এটার দখল নিয়ে নিয়েছে আরাকান আর্মি। আরকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব। সেই আলোচনা আমরা একই সমান্তরালে চালু করেছি। আমাদের আরাকান আর্মি সুস্পষ্টভাবে বলেছে , রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া তাদের একটি প্রিন্সিপ্যাল পজিশন, একই কথা আমাদের মিয়ানমার সরকার উল্লেখ করেছে। আরাকান আর্মি বলেছে, পরিস্থিতি অনুকূলে হলে তারা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেবে। আরাকানে যুদ্ধাবস্থা এখনও নিরসন হয়নি।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেন, রাখাইন অঞ্চলে ব্যাপক খাবার, ওষুধের অভাব। ইউএনডিপি রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে এক ধরনের ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে খাবার ওষুধ না পেয়ে আমাদের দেশে চলে আসতে পারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাদেরই আমাদের দেশে চলে আসার প্রবণতা বেশি হতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করছি প্রায় ৮ বছর ধরে। আমরা ভার ধারণের সীমার বাইরে চলে এসেছি। অতিরিক্ত শরণার্থী গ্রহণ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় রাখাইন সম্প্রদায় আমাদের সীমান্তে এসে খাদ্য এবং ওষুধের সহায়তা চেয়েছে। তারা যদি আসা শুরু করেন তাহলে আমাদের নতুন ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। আমরা সেটা এড়াতে চাচ্ছি। জাতিসংঘের কার্যক্রম যেটা মিয়ানমারে চলছে, সেটা রাখাইনে আর চালানো সম্ভব না। কারণ যুদ্ধাবস্থার কারণে মানবিক যেকোনও ধরনের ত্রাণ রাখাইনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘ মহাসচিব গত মার্চে এসে আমাদের বললেন যে আমরা রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা দিতে পারি কিনা? আমরা বিষয়টি বিবেচনা করছি। কিন্তু এতে বেশ কিছু আবশ্যিকতা আছে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আরাকান আর্মিকে জানানো হয়েছে যে এই সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। কাউকে এর থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, এটা কোনও যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের মধ্যে শঙ্কা হচ্ছে আরাকানে যে নতুন প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে আমরা তাতে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের কোনও চিহ্ন দেখছি না। আমরা আরকান আর্মিকে সরাসরি বলে দিয়েছি কোনও প্রকার জাতিগত নিধন আমরা সহ্য করবো না। তারা যদি শুধু রাখাইন দিয়ে পরিচালনা করতে চায় সেটাও আমরা মেনে নিতে পারবো না। আমরা আশা করছি তারা এর সদুত্তর দেবে। আমরা এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চাই।