রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬ মাসে নিহত ৭৯

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ৬ দিন আগে

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার কমপক্ষে ৫২৯টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭৯ জন। অন্তত ৪ হাজার ১২৪ জন আহত হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, কমিটি নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন দখলকে কেন্দ্র করে এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এসব তথ্য জানিয়েছে।

সোমবার (৭ জুলাই) সন্ধ্যায় সংস্থাটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৫২৯টি সহিংসতার ঘটনার মধ্যে ৪৪৫টিই ঘটেছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য দলের সংঘর্ষে। শুধুমাত্র বিএনপির অন্তর্কোন্দলের ঘটনায় ৩০২টি সংঘর্ষে অন্তত ২ হাজার ৮৩৪ জন আহত হয়েছে, নিহত হয়েছেন ৪৬ জন।

এতে বলা হয়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে ১০১টি ঘটনায় আহত হয়েছে ৫০২ জন ও নিহত ১৬ জন। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ২৬টি, এতে আহত হয়েছেন ২১৬ জন এবং নিহত হয়েছেন ২ জন।

বিএনপি-এনসিপি সংঘর্ষে আহত ৭৯ জন, আওয়ামী লীগ-এনসিপি সংঘর্ষে ৫৪ জন আহত এবং একজন নিহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ-জামায়াত সংঘর্ষে আহত ৯ জন ও নিহত একজন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৩টি ঘটনায় আহত ১৫৩ জন ও নিহত ৭ জন এবং এনসিপির অন্তর্কোন্দলে ১২টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৩৭ জন। এছাড়াও, ৪২টি ঘটনায় সংঘর্ষ হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে। নিহত ৭৯ জনের মধ্যে ৫৪ জন বিএনপির, ১৭ জন আওয়ামী লীগের, দুজন জামায়াতের, একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের এবং তিন জন ইউপিডিএফের সদস্য। অপর দুইজনের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি, যাদের মধ্যে একজন নারী।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর দুষ্কৃতকারীদের হামলার অন্তত ৭৬টি ঘটনায় আরও ৫৭ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে শতাধিক। নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২০ জন, বিএনপির ২৯ জন, জামায়াতের নারী সদস্যসহ দুইজন এবং চরমপন্থি দলের চারজন রয়েছে।

গত ছয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ১১০ জন। এছাড়া, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হয়েছে ৬ শতাধিক বাড়ি-ঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহন। মানবাধিকার সংস্থাটি এ সহিংসতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে।

সাংবাদিকদের ওপর বেড়েছে নিপীড়ন

জানুয়ারি-জুন মাসে মোট ১৫২টি হামলা ও হয়রানির ঘটনায় ২৫৭ জন সাংবাদিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১১১ জন, লাঞ্ছিত ২০ জন, হুমকির মুখে পড়েছেন ৩৪ জন এবং ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ সময়ে ২২টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ৯২ জন সংবাদকর্মীকে—যা সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তোলে। একই সময় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’–এর আওতায় ৫টি নতুন মামলা ছাড়াও আগে হওয়া ১৬টি মামলায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার ও ২৩ সাংবাদিক অভিযুক্ত রয়েছেন।

গণপিটুনির লাগাম‑ছাড়া প্রবণতা

এই ছয় মাসে গণপিটুনির ১৪১টি ঘটনায় অন্তত ৬৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ১১৯ জন। লক্ষ্মীপুরের মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধকে ‘চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ‘ডাকাত’ ঘোষণা দিয়ে দুই জামায়াতকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা—শতাধিক উদাহরণ দেখাচ্ছে জনরোষ কীভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে জুতার মালা পরানোর ঘটনাও নজর কেড়েছে, যা নাগরিক নিরাপত্তা ও সহিষ্ণুতার সংকটকে সামনে আনে।

কারাগারে মৃত্যু ও ‘স্বাভাবিক’ নয়

গত ছয় মাসে জেলখানায় মারা গেছেন ৪০ জন কারাবন্দি। এর মধ্যে ১৩ জন সাজাপ্রাপ্ত এবং ২৭ জন বিচারাধীন আসামি। নিহতদের তালিকায় খুলনা, নওগাঁ, সুনামগঞ্জ ও কুমিল্লার চার আওয়ামী লীগ নেতা রয়েছেন, যা কারা–নিরাপত্তা ও চিকিৎসা–ব্যবস্থায় গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

সংখ্যালঘুদের বাড়ি‑ঘরে আগুন ও ভাঙচুর

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত ১০টি হামলায় চারজন আহত হয়েছেন। ধ্বংস করা হয়েছে একটি অস্থায়ী মন্দির, ১১টি প্রতিমা ও ১৮টি ঘর। যশোরের অভয়নগরে বিজেপি‑পন্থি মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৩ পরিবারে অগ্নিসংযোগ এবং রাজশাহীর খেতুরীধামে মিলনমেলায় হামলার ঘটনায় সম্প্রীতি‑চিত্রটা আরও ম্লান। প্রতিবেদনে মাজারসহ ৪০টির বেশি ধর্মীয় স্থাপনায় ভাঙচুর‑লুটপাটের কথাও উঠে আসে।

শ্রমিক নিপীড়নে জীবনের দাম সস্তা

শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ১১২টি ঘটনায় ৫৯ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭২০ জন। মার্চে পোশাকশিল্পে বকেয়া ও ঈদ বোনাস দাবিতে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ৭৫ জন আহত হন। কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় ৪৩ শ্রমিক মারা গেছেন, তিন গৃহকর্মী মালিকের নির্যাতনে নিহত এবং দুজন গুরুতর আহত হয়েছেন।

সীমান্তে নতুন ‘মৃত্যুকথা’

ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে ৪০টি ঘটনায় বিএসএফের গুলিতে ১৪ বাংলাদেশি নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন; গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৭ জন। একই সময়ে বিএসএফ ২ হাজার ৩৩৮ জনকে পুশ‑ইন করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির গুলিতে আহত দুই বাংলাদেশি এবং ল্যান্ডমাইনে ৯ বাংলাদেশি নাগরিকের জখমের তথ্যও রয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র ভয়াবহ

ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার ৪৭৬ নারী-শিশুর মধ্যে ৬০ ভাগই ১৮ বছরের নিচে। ধর্ষণের পর হত্যা ১৪টি এবং আত্মহত্যা ৭টি; যৌতুক ও পারিবারিক সহিংসতায় নিহত ১৯ ও ১৬৬ জন। শিশুনির্যাতনের ঘটনায় ৬৭৩ শিশুর মধ্যে ১৩২ জনের মৃত্যু—সংখ্যাটি যেকোনও সমাজের জন্য লজ্জাকর।

আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

সংঘর্ষ, হেফাজত ও নির্যাতনে ছয় মাসে কমপক্ষে ১৪ জন নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়েছেন; অভিযোগের শিকার হয়েছেন পুলিশ, র‌্যাব ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাও। ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘গোয়েন্দা অভিযানে মৃত্যু’ ও ‘পুলিশি নির্যাতন’—পুরোনো শব্দগুলোই বারবার ফেরত এসেছে।

রাজনৈতিক মামলা ও গণগ্রেপ্তারের রেকর্ড

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নামে ১১৬টি মামলায় ৮ হাজার ৫৬৬ জনকে নাম উল্লেখ করে এবং ১৫ হাজার ৯৩০ জনকে ‘অজ্ঞাত’ দেখিয়ে আসামি করা হয়েছে। গত ছয় মাসে গ্রেপ্তার অন্তত ২৩ হাজার ১২১ জন; যার ২২ হাজার ৯৯৫ জনই সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মী বলে দাবি প্রতিবেদনের। নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের ৪৫ সদস্যসহ চিহ্নিত ‘অপরাধী ধরতে’ সাম্প্রতিক ‍‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে আরও কয়েক হাজার মানুষ আটক হয়েছেন।

মানবাধিকার সংস্থাটি মনে করে, ‘আইনের শাসন সুদৃঢ়, গণতন্ত্র কার্যকর ও নাগরিক স্বাধীনতা সুরক্ষিত না হলে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটবে।’ সংগঠনটি সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক মহলকে সংলাপ‑ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে সহিংসতা ও দমনমূলক প্রবণতা বন্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

  • নিহত
  • রাজনৈতিক সহিংসতা
  • #