যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে : সিপিডি

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ ঘন্টা আগে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ (আরটি) বা পাল্টা শুল্ক ঘিরে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় এক নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে এ পতনের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি বাড়তি শুল্কহার ১০ শতাংশ হলেও পোশাক রপ্তানি কমতে পারে ৩৪ শতাংশ। এই প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বাংলাদেশের বৈশ্বিক রপ্তানি ক্ষেত্রেও নেতিবাচক ছাপ ফেলবে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে ৯ শতাংশ পর্যন্ত। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এমন তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটির ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে গবেষক আনিকা তাসনিম অর্পিতা ও তানবিন আলম চৌধুরী একটি ‘পলিসি ব্রিফ’ তৈরি করেছেন।

সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, পাল্টা শুল্ক মানে এক দেশ আমদানি করা পণ্যে যতটা শুল্ক আরোপ করে, রপ্তানিকারক দেশও আগের দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে ততটাই শুল্ক আরোপ করে। ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি হলো, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, সেসব দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হবে যেন পারস্পরিক বাণিজ্যে ভারসাম্য ফেরানো যায়। ভারসাম্য ফেরাতে দেশটি বাড়তি যে শুল্ক আরোপ করেছে, তার হিসাবটি মূলত এমন– কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণকে সেই দেশ থেকে আমদানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে, তার অর্ধেককে অতিরিক্ত শুল্ক হিসেবে আরোপ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি একটি সর্বজনীন ভিত্তিশুল্ক হার হিসেবে ১০ শতাংশও সংযোজিত হয়েছে। এই সূত্র দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সে দেশে আমদানি করা পণ্যের জন্য আরটি হার নির্ধারণ হয়েছিল ৩৭ শতাংশ। যদিও এটি এখনও কার্যকর হয়নি। এ শুল্কহার কার্যকরের দিনে ১ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে নতুন শুল্কহার ৩৫ শতাংশ কার্যকর হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ নীতি বাস্তবায়ন হলে, এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশসহ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকারক দেশের ওপর।

‘পাল্টা শুল্ক’ কি আসলেই পাল্টা?

সিপিডির মূল্যায়নে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যেখানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে নেয় মাত্র ২ দশমিক ২০ শতাংশ (শুল্ক রেয়াতসহ)। আবার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মতো প্রধান রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেয় ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ শুল্ক। ফলে প্রশ্ন ওঠে– যেখানে বাংলাদেশ অনেক কম শুল্ক নিচ্ছে, সেখানে কীসের ‘পাল্টা শুল্কের’ কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র।

আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র কেবল পণ্য বাণিজ্য বিবেচনায় নিচ্ছে। অথচ সেবা খাতে– যেমন সফটওয়্যার, কনসালট্যান্সি, ই-কমার্স বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। একইভাবে রেমিট্যান্স কিংবা কর্মসংস্থানের প্রশ্নেও বাংলাদেশের তুলনামূলক দুর্বলতা যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধার খাতেই পড়ছে।
বড় প্রভাব পড়তে পারে রপ্তানিতে

বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ঘোষিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে এ পতনের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি বাড়তি শুল্কহার ১০ শতাংশ হলেও পোশাক রপ্তানি কমতে পারে ৩৪ শতাংশ। এই প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বাংলাদেশের বৈশ্বিক রপ্তানি ক্ষেত্রেও নেতিবাচক ছাপ ফেলবে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে ৯ শতাংশ পর্যন্ত।

এতে বলা হয়, বড় পোশাক আমদানিকারক ব্র্যান্ড ও কোম্পানিগুলো কিছুটা বাড়তি খরচ নিজেরা বহন করলেও, সেই চাপের একটি বড় অংশ সরবরাহকারী দেশগুলোর উদ্যোক্তাদের কাঁধেই চাপানো হবে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা, বিশেষত ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে যেখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কাঁচামালের উচ্চমূল্য এবং ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার সামলে কোনোভাবে টিকে আছে, সেগুলো বেশি সমস্যায় পড়বে। অতিরিক্ত শুল্ক চাপ তাদের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলবে।
উত্তরণে প্রয়োজন কৌশলী কূটনীতি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের বিষয়ে দর কষাকষি করতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার শুল্ক সংক্রান্ত বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন– ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক বাতিল, ৬৫টি পণ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাস, ৯টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ বাতিল এবং ৪৪২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক হ্রাস। সিপিডি মনে করে, শুধু শুল্ক কমিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে বাড়তি শুল্কহার কমানোর সম্ভাবনা কম। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের একদিকে যেমন বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোতে সক্রিয় থাকতে হবে, অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুচিন্তিত আলোচনায় বসতে হবে। বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জানতে চাওয়া– তারা আসলে কোন কোন পণ্যে শুল্ক ছাড় চায় এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিময়ে কী চাওয়া যায়।

একই সঙ্গে এফটিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা নিয়েও কাজ শুরু করা দরকার। যদি বাংলাদেশ এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক ছাড় দেয়, তবে ডব্লিউটিও নিয়ম অনুসারে অন্যান্য এমএফএন দেশের কাছেও একই সুবিধা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে এমএফএন বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তুলা সরবরাহকারী। সিপিডি মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলা ব্যবহার করে তৈরি পোশাকের জন্য শুল্ক ছাড়ের বিশেষ সুবিধা আদায়ের সুযোগ আছে। এ ছাড়া তুলার জন্য বিশেষ গুদাম সুবিধা ও বিলম্বিত মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা দিলে তা রপ্তানিতে সহায়ক হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা গেলে তা কেবল রপ্তানি সহায়ক নয়, বাংলাদেশের পণ্যে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার পথ খুলে দিতে পারে।

  • বাংলাদেশ
  • যুক্তরাষ্ট্র
  • রপ্তানি
  • সিপিডি
  • #