গুলশানে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যবহিষ্কৃত ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ সবসময় দলবল নিয়ে চলাফেরা করতেন। বিভিন্ন অফিসে গিয়ে সমন্বয়ক পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন। গ্রেপ্তারের পর রিয়াদের নানা অপকর্ম, ছবি, ভিডিও সামনে আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এসব ছবি ও ভিডিও।
পুলিশকেও নানা কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন রিয়াদ। কোনো পুলিশ তার কথা না শুনলেই হুমকি-ধমকি দিতেন। তার কথা মতো কাজ না করায় মব সৃষ্টি করে সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি থানার পরিদর্শককে (তদন্ত) প্রত্যাহার করান তিনি। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের সাবেক এক সংসদ সদস্যের কাছ থেকে রিয়াদ বড় অঙ্কের চাঁদা নিয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত এপ্রিলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) এক নেতাকে ভাটারা থানা এলাকায় আটকিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন রিয়াদ। চিকিৎসক দুই লাখ টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু তিনি পুরো টাকাই চান। একপর্যায়ে ওই চিকিৎসককে রিয়াদ ও তার সহযোগীরা ধরে গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে নিয়ে যান।
পুলিশ কর্মকর্তারা রিয়াদকে বোঝানোর চেষ্টা করেন- চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হবে। কিন্তু তাতে রাজী ছিলেন না রিয়াদ। ইনি-বিনিয়ে টাকার কথা বলেন। একপর্যায়ে পুলিশ ওই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠান।
পুলিশের এক কর্মকর্তা রিয়াদকে প্রশ্ন করেন- রাস্তা থেকে কাউকে আটক করার ক্ষমতা তিনি কিভাবে পেলেন। এটি তো তার কাজ নয়। একপর্যায়ে রিয়াদ পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে বলেন, তিনি আন্দোলন করেছেন। তিনি কোনো দোসরদের আটক করতে পারবেন না? তিনি একজন জুলাই যোদ্ধা। একপর্যায়ে সেসময়ের ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুজন হক চার-পাঁচজন সহযোগীসহ তাকে ভাটারা থানায় নিয়ে যান। তখন রিয়াদ পুলিশের কাছে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি পান।
পুলিশের গুলশান বিভাগের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন বাসায় আওয়ামী লীগের দোসর অবস্থান করছেন অভিযোগ তুলে পুলিশকে যেতে বলতেন। অবশ্য পুলিশকে খবর দেওয়ার আগে সহযোগীদের নিয়ে রিয়াদ আগেই ওইসব বাসায় যেতেন। যেসব স্থানে চাঁদাবাজি করতে পারতেন না, সেখানে পরবর্তীতে দোসরের অবস্থানের কথা বলে পুলিশকে নিয়ে যেতেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রিয়াদ লোকজন নিয়ে বনানীতে সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটনের বাসায় গিয়ে মব সৃষ্টি করেন।
একটি থানার এক কর্মকর্তা জানান, গত মার্চে ভাটারা এলাকায় একটি বাসায় গিয়ে রিয়াদ ও তার সহযোগীরা মব সৃষ্টি করেন। পরে পুলিশকে ফোন দেন সেখানে যেতে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তিনি তাকে বলেছিলেন, পুলিশ যাবে তবে বাসায় প্রবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভিডিও করা হবে। যাতে কেউ কোনো অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করতে না পারে।
এপ্রিলেও ভাটারা এলাকায় একটি বাড়িতে আওয়ামী লীগের দোসর অবস্থান করছে অভিযোগ তুলে রিয়াদরা প্রবেশ করেছিলেন। পরে সেখানে টাকা-পয়সা নিতে না পেরে পুলিশকে খবর দেন। এ ছাড়া খিলবাড়ির টেকে জমি দখল করে দেওয়ার নাম করে এক নারীর কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন রিয়াদ। ওই নারী ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। পরে ভাটারা থানার এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই জমি দখলে সহযোগিতা করতে বলেন রিয়াদ। কর্মকর্তা বলেছিলেন- আদালতের অনুমতি না থাকলে কোনো জমি দখল করে দেওয়ার কাজে যেতে পারবেন না। কর্মকর্তার ওপর চড়াও হন তিনি।
গত শনিবার গুলশান ২ নম্বরের ৮৩ নম্বর সড়কে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেত্রী শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন রিয়াদ ও তার চার সহযোগী। এর আগে ওই বাসা থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা এনেছিলেন। শনিবার বাকি ৪০ লাখ টাকা আনতে গিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার অপর চারজন হলেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার সদ্য বহিষ্কৃত আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন মুন্না, সদস্য সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব এবং আমিনুল ইসলাম। আমিনুল কিশোর হওয়ায় তার রিমান্ডে নেওয়া হয়নি। রিয়াদসহ চারজনকে রিমান্ডে নিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা শাম্মীর বাসায় চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেছেন।
গুলশান থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়ে চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।