২০ শতাংশ শুল্কে স্বস্তি, চুক্তির শর্ত না জানায় সংশয়

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ ঘন্টা আগে

বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আরোপ করা শুল্ক হার ২০ শতাংশে কমিয়ে আনাকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘ঐতিহাসিব চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন ‘এটা সুস্পষ্ট এক কূটনৈতিক সাফল্য’। তবে কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন, আপাতত স্বস্তি ফিরলেও সার্বিকাভাবে শঙ্কামুক্ত হতে চুক্তিতে কী কী শর্ত আছে তা জানা জরুরি।

ডনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে অবশেষে স্বস্তিতে বাংলাদেশ। বিশ্লেষক, পোশাক শিল্পের মালিক ও কূটনীতিকরা মনে করছেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ একই অবস্থানে থাকায় আপাতত বাংলাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শঙ্কা কাটলো। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরিপোশাকের একক দেশ হিসাবে সবচেয়ে বড় গন্তব্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে তৈরি পোশাক থেকে।

ট্রাম্প তার সর্বশেষ ঘোষণায় বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছেন। আগে থেকে আছে ১৫ শতাংশ। ফলে, এখন মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়ালো ৩৫ শতাংশ। কিন্তু ২ এপ্রিল শুরুতে এই পাল্টা শুল্ক ধরা হয়েছিল ৩৭ শতাংশ। তারপর করা হয় ৩৫ শতাংশ। এখন সেটা ২০ শতাংশ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর সমানই রয়েছে। তবে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। ভারতের ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ। পাকিস্তানের ১৯ শতাংশ। পাকিস্তানের এই সারিতে আরো আছে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ও ফিলিপাইন্স। ২০ শতাংশে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম। আর ২৫ শতাংশে ভারত ছাড়াও আছে ব্রুনাই, কাজাখস্তান, মলডোভা ও টিউনিসিয়া।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৯৮ ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে প্রচলিত পণ্যের বাইরে অনেক অপ্রচলিত পণ্যও রপ্তানি হয়। তবে রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে।

সিপিডির গবেষষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ তার প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে একই অবস্থানে বা দুই-একটি দেশের সাথে ভালো অবস্থানে আছে। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এখনো আলোচনা চলছে। তবে তারাও বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে বলে মনে হয় না। তবে চুক্তিতে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফ’ বলে একটি ক্লজ আছে। সেখানে বলা আছে, যেসব দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হবে, সেইসব দেশের শুল্ক যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আবার সেই কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে ৪০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এটা নিয়ে ভাবার আছে। আসলে পুরো চুক্তি ভালো করে দেখার আগে পরিস্থিতি সম্পর্কে আর বেশি মন্তব্য করা কঠিন। আমরা ভারত ও চীন থেকে প্রধানত কাঁচামাল আনি। এটা হলে সেই চাপ তাদের ওপরও পড়বে।

তার কথা, এখন আরো একটি বিষয় আসবে আর তা হলো, এই বাড়তি শুল্ক কে দেবে। যদি ভোক্তার ওপর চাপায়, তাহলে চাহিদা কমে যাবে। তবে আমার ধারণা, এটা উৎপাদক এবং বায়ার ভাগ করে নেবে। সেটা হলেও বাংলাদেশি উৎপাদকরা, বিশেষ করে তৈরি পোশাক উৎপাদনকারীদের মুনাফা কমবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৯.১ ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩.৭৯ শতাংশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাকের বাাজার বাড়ছে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ কোটি ডলার। কিন্তু জুন মাসে তা কমে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৫১ কোটি ডলার। ট্রাম্পের এই শুল্ক ইস্যুতে পোশাক খাতে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, এই আশঙ্কা আপাতত নেই। যুক্তরাষ্ট্রে জিন্সসহ বেসিক ক্যাটাগরির টি-শার্টসহ অন্যান্য পোশাক যায়।

বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, তৈরি পোশাকে আমাদের প্রতিযোগী চীন, ভারত, তাইওয়ান। এখন যা দেখছি, তাতে আমরা স্বস্তিজনক অবস্থায় আছি। চীনের সাথে এখনো শুল্ক ঠিক হয়নি। তারপরও সমস্যা হবে বলে মনে করি না। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা তৈরি করি বেসিক প্রোডাক্ট, যা অন্য দেশগুলো তেমন করে না। ফলে, সেই অর্থে আমাদের প্রতিযোগী তেমন নেই। এখন যে অর্ডারগুলো হোল্ড করা হয়েছিল, তা আবার চালু হয়ে যাবে। আমাদের তৈরি পোশাক খাতে কোনো নেতিবাচক প্রবাভব পড়বে না। বরং ভারতের তুলনায় আমাদের ভালো করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন,  পোশাকের দাম তো বাড়বে। আমি এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছি। এখানকার বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমছে। এখন এটা কীভাবে সামাল দেয়া যায় সেটাই প্রশ্ন। আমাদের সাথে বায়ারদের কথা শুরু হয়েছে। আমরা বাড়তি শুল্ক কিভাবে ভাগ করবো তা নিয়ে কথা হচ্ছে। একটি অংশ ভোক্তাদের ওপর পড়বে আর বাকিটা হয়তো উৎপাদক এবং বায়াররা ভাগ করবো। কিন্তু আমরা তো উৎপাদন করি। আমরা তো কস্ট (খরচ) কমাতে পারবো না। ফলে লাভ কমাতে হবে। সেটা যাদের বড় প্রতিষ্ঠান, যাদের পুঁজি বেশি, তাদের জন্য সমস্যা নয়। কিন্তু ছোট কারখানার জন্য সমস্যা।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নিট গার্মেন্টসগুলো কাঁচামাল কম আমদানি করে। তাদের অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন বেশি, তারা নিজেরাই কাঁচামাল তৈরি করে। তারা তুলনামূলকভাবে এই মার্কিন শুল্কে ভালো থকবে। আর ওভেন গার্মেন্টস যারা অনেক বেশি কাঁচামাল বাইরে থেকে আনে, তাদের চীন বা ভারত বাদ দিয়ে বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনলে তাদের জন্য ভালো হবে। নয়তো ট্রান্সশিপমেন্ট ট্যারিফের চ্যালেঞ্জ সামনে আসতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, এটা কূটনৈতিক সাফল্য বা ঐতিহাসিক চুক্তি কিনা তা বলতে পারবো না। তবে, আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। আমাদের আটশ’র মতো পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতো, অনেক কর্মী বেকার হয়ে যেতেন, তা এখন আর হচেছ না। যে অর্ডার স্থগিত হয়েছিল, তা আবার ছাড় হবে। এটা নিশ্চয়ই আশার কথা। তবে তাইওয়ান যেভাবে শুরুতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের সব ধরনের কানেকশন নিয়ে, আমরা তা করিনি। তারা কূটনৈতিক এবং স্টেক হোল্ডারদের এক করে কাজ করেছে। ফলে, শুরুতেই তারা ফল পেয়েছে। তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছে। কিন্তু আমরা সেভাবে না করায় তিন মাস পুরো দেশ আতঙ্কে ছিল। শেষ মূহুর্তে আমরা সমাধান পেয়েছি। আমি মনে করি, তিন মাস আমরা এক ধরনের ক্ষতির মুখে ছিলাম। তবে এখনো আমরা চুক্তির ধারাগুলো জানি না। সেখানে আমরা কী দিয়েছি তা তো এখনো জানি না। আর এর মধ্যে নন-ডিসক্লোজার চুক্তি সই হয়েছে। সেখানে কী আছে। তা-ও তো জানি না। এটা তো দেশের মানুষ জানতে চায়। আর নিরাপত্তা ইস্যুর কথা বলা হচ্ছে। আমাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিরপত্তার প্রশ্ন কেন থাকবে- এ প্রশ্ন তার।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, সেই তুলনায় আমদানির পরিমাণ অনেক কম। ইউনাইটেড স্টেটস সেন্সাস ব্যুরো বলছে, জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২০ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে এবং ফেব্রুয়ারিতে এনেছে মাত্র আট কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে ওই দুই মাসে মোট ২৯ কোটি ৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছে। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পাঠিয়েছে তৈরি পোশাক। আর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি এনেছে সয়াবিন। গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার।

পাল্টা শুল্ক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় টার্গেট ছিল বণিজ্য-ঘাটতি কমানো আর দেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ানো। যে ট্রান্সশিপমেন্ট শুল্কের কথা এখন আবার জানা যাচ্ছে তা-ও আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল রপ্তানি বাড়ানোর জন্য । যুক্তরাষ্ট্র ফিনিশড প্রোডাক্ট এবং কাঁচামাল দুইটির রপ্তানিই বাড়াতে চায়। সেই কারণেই শুল্ক আলোচনায় ফল পেতে শেষ দফা আলোচনায় যাওয়ার আগে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানির অনুমোদন দেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি নতুন বোয়িং বিমান আনারও চুক্তি করার কথা বলে। এর আগে প্রতি বছর পাঁচ লাখ টন এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। এছাড়াও সয়াবিন ,তুলা, ডাল আমদানিরও নতুন চুক্তি হচ্ছে। অন্যদিকে স্টারলিংক বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন,  যুক্তরাষ্ট্রে সাথে ট্রেড গ্যাপ কমাতে ২৫টি বোয়িং আনা হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মধ্যে বোয়িং নাই। তাহলে কেন আনা হচ্ছে? এতে তো আমাদের আরো ঋণ করতে হবে। কিন্তু লাভ কী হবে? আর আমাদের বিমান বাংলাদেশ এয়ালাইন্স তো এমনিতে লোকসানি প্রতিষ্ঠান। সয়াবিন ,তুলা, ডাল আমাদের প্রয়োজন। দাম বেশি হলেও আনা যায়। কারণ, আমাদের বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে হবে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় পণ্য এনে সেটা করলে তো আমরা বৈদেশি মুদ্রার সংকটে পড়ব। সরকারের সবার আগে উচিত এখন চুক্তি প্রকাশ করা। সেটা হলে আমাদের লাভ-লোকসানের হিসাব করতে সুবিধা হবে।

সূত্র : ডয়চে ভেলে (প্রতিবেদক : হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা))

  • ২০ শতাংশ
  • চুক্তি
  • শর্ত
  • শুল্ক
  • সংশয়
  • #