ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ অস্ত্র ও আড়াই লাখের মতো গোলাবারুদ এক বছরেও উদ্ধার হয়নি। পুলিশের লুণ্ঠিত সব অস্ত্র-গুলি উদ্ধার না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির ঝুঁকি দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির স্বার্থে দ্রুত এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের তাগিদ দিয়েছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রে জানা যায়, সে সময় বিভিন্ন থানা ও পুলিশের স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫৩ আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৭ হাজার ২৬২টি গুলি লুট হয়। পাশাপাশি ৩২ হাজার ৫টি টিয়ার গ্যাসের শেল, ১ হাজার ৪৫৫ টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড, ৪ হাজার ৬৯২ সাউন্ড গ্রেনেড, ২৯০ স্মোক গ্রেনেড, ৫৫ স্টান গ্রেনেড, ৮৯৩ মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড এবং ১৭৭টি টিয়ার গ্যাস স্প্রে লুট হয়।
১২ আগস্ট থেকে পুলিশ সদর দপ্তর একাধিকবার লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার আহ্বান জানায়। গত ৩ সেপ্টেম্বর এগুলো জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়।
সেপ্টেম্বর থেকেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী যৌথ অভিযান চালায় অন্তর্বর্তী সরকার। সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যরা এই অভিযানে অংশ নেন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে এখনো ১ হাজার ৩৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। লুণ্ঠিত ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ গোলাবারুদের মধ্যে উদ্ধার হয়নি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০টি। গত ৩১ জুলাই এই তথ্য পাওয়া যায়।
জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে বলা হয়। এ ছাড়া এর আগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে থানার লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। নির্দিষ্ট তারিখের পরে কারও কাছে পুলিশের লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়।
পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে বেসামরিক নাগরিকদের অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল প্রায় ৫০ হাজার।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে শুধু রাজধানী ঢাকায় ১৫৪টি খুন, ৩৩ ডাকাতি, ২৪৮ ছিনতাই এবং ১ হাজার ৬৮টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ না করায় ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুরুত্বসহ দেখছে। সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি খুন, ছিনতাইয়ে অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো ধরনের অস্ত্র ব্যবহার আমাদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। লুট হওয়া অস্ত্র বা যেকোনো অবৈধ অস্ত্র বা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার যেন না হয়, এসব বিষয় আমাদের নজরে আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।’
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, দেশে ৬৬৪টি থানা আছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। এসব স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদ লুট হয়। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।
লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এ অভিযানে গত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫৮টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৩৮টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো ১ হাজার ৩৯২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬০ হাজার ৫৩১টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আকরাম হোসেন বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশের খোয়া যাওয়া কিছু অস্ত্র আবার খাল–বিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান চলছে। লুট করা অস্ত্র নিয়ে কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে ২ হাজার ২০০ আসামি পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো ৭০০ আসামি পলাতক। তাঁদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ অতিঝুঁকিপূর্ণ ৭০ জন আসামি রয়েছেন।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, জেল পলাতক ৭০০ আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। তাঁদের মধ্যে ১০০ জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে দু-একজন করে ধরা পড়ছেন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন ছিনতাই-ডাকাতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যৌথ বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ মনোযোগ না দিলে জননিরাপত্তা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়বে।