এনসিপিতে পদত্যাগের হিড়িক

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ৩৮ minutes ago

দলীয় কর্মকাণ্ডে হতাশা, অনিয়মের অভিযোগ, না জানিয়ে পদায়ন বা অন্য দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা—এমন নানা কারণ দেখিয়ে গত দুই মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে প্রায় ২৫ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। একই সময়ে কমিটি স্থগিতের ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতির জন্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ।

এনসিপি সূত্রে জানা যায়, দলীয় নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে গত ১ জুন ঢাকা মহানগর উত্তরে সমন্বয় কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এনসিপির কমিটি গঠন শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দেশের ৩৩টি জেলা ও প্রায় ২০০টি উপজেলায় সমন্বয় কমিটি করেছে এনসিপি। এসব কমিটি গঠনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরিবারের সদস্যকে পদায়ন, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ও সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন অনেক নেতা। শুধু সিলেট জেলা থেকেই পদত্যাগ করেন ৯ জন। বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় দুটি শাখা কমিটি স্থগিতও করা হয়। এর আগে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পরপর পদত্যাগ করেছিলেন তিন নেতা।

এনসিপি নেতারা বলছেন, মূলত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য তাড়াহুড়া করে কমিটি ঘোষণা করায় এমন ঘটনা ঘটছে। কমিটি গঠনের সময় তেমন যাচাই-বাছাই করা হয়নি। তবে কারও কারও দাবি, এনসিপিকে বিতর্কিত করার জন্যই বিএনপি ও জামায়াতের কেউ কেউ দলটিতে যুক্ত হয়ে আবার পদত্যাগ করেছেন।

গত ৯ আগস্ট মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা সমন্বয় কমিটি থেকে একসঙ্গে পদত্যাগ করেন এনসিপির চার নেতা। সেদিন বিকেলে শিবচর প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তারা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এই চার নেতা হলেন—উপজেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী শাকিল খান এবং সমন্বয় কমিটির সদস্য মো. রিয়াজ রহমান, মহিউদ্দিন ও কাজী রফিক। পদত্যাগ করার কারণ হিসেবে তারা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দুঃখজনকভাবে লক্ষ করছি যে, শিবচর থানায় দল পরিচালনার দায়িত্ব কিছু অযোগ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, যারা আদর্শিক, নৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে সম্পূর্ণ অযোগ্য। এর ফলে দলের প্রকৃত, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী কর্মীরা যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ ধরনের নেতৃত্বের মাধ্যমে শিবচরের ইতিবাচক পরিবর্তন বা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

এরপর ১০ আগস্ট ফরিদপুরের সমন্বয় কমিটির সদস্য মো. রুবেল মিয়া (হৃদয়) পদত্যাগ করেন। এনসিপির ফরিদপুর জেলা সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী সৈয়দা নীলিমা দোলার কাছে দেওয়া পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, সম্প্রতি দলের কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ, দলের সিদ্ধান্ত এবং অবস্থানগুলো জুলাই বিপ্লবের নীতি ও নৈতিকতার পরিপন্থি বলে মনে হওয়ায় এবং দলটির বর্তমান পথচলা তার ব্যক্তিগত আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তিনি গভীরভাবে হতাশ ও বিচলিত।

এর আগে ৮ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার জাতীয় নাগরিক পার্টির সমন্বয় কমিটি থেকে ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী এ ইউ মাসুদ (আরফান উদ্দিন) পদত্যাগ করেন। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তিনি এ সিদ্ধান্ত জানান। পদত্যাগের বিষয়ে এ ইউ মাসুদ বলেন, কমিটি দেওয়ার আগে জানানো হয়েছিল, আমি প্রধান সমন্বয়কারীর পদ পাব। কিন্তু কমিটি প্রকাশ হওয়ার পর দেখলাম, যুগ্ম সমন্বয়কারীর পদ দেওয়া হয়েছে। এখানে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন কিংবা সম্পর্ক অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

একইদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে দুই নেতা—শরীয়তপুর জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ডামুড্যা উপজেলা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী তারিকুল ইসলাম এবং জেলা কমিটির সদস্য পলাশ খান পদত্যাগ করেন। তারা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগের কথা জানান।

এর আগে এনসিপির ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন ইসমাইল হোসাইন ও ইঞ্জিনিয়ার আলাউদ্দিন নামে দুই নেতাও, যারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পরিবারের লোক বলে উল্লেখ করেন। পদত্যাগের বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমি জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পরিবারের লোক। দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি করায় মামলা-হামলার শিকার হয়েছি। এনসিপির উপজেলা কমিটিতে আমাকে রাখার বিষয়ে পূর্বে অবগত করা হয়নি, এমনকি আমি তাদের কোনো কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করিনি। তাই আমি পদত্যাগ করেছি।’

গত ২৯ জুন এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত মতলব দক্ষিণ উপজেলা শাখার সমন্বয় কমিটি ঘোষিত হয়। এর কিছুক্ষণ পরই ওই কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ডি এম আলাউদ্দিনকে ‘জাতীয় পার্টির নেতা ও ‘ফ্যাসিস্টের সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগ করেন যুগ্ম সমন্বয়কারী হেলাল উদ্দিন। নিজের ফেসবুক আইডি থেকে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

এ ছাড়া ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এবং কেন্দ্রীয় দপ্তরে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে এনসিপি বাগমারা উপজেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন তিন সদস্য—হাদিউজ্জামান রাফি, ফুয়াদ হাসান গানিম ও রাবিউল ইসলাম রাহুল। এ বিষয়ে হাদিউজ্জামান রাফি বলেন, ‘আমি রাজনীতি করতে চাই না, এ কথা আগেই তাদের জানিয়েছিলাম। তবু আমার নাম কমিটিতে রাখা হয়েছে। তাই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে নিজেকে সব সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির অনুরোধ জানিয়েছি।’ আরেক পদত্যাগী নেতা ফুয়াদ হাসান গানিম বলেন, ‘আমি বিএনপি পরিবারের সন্তান। একাধিকবার অনিচ্ছার কথা জানানোর পরও আমার নাম কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছি।’

এ বিষয়ে এনসিপির উপজেলা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী আলী মর্তুজা বলেন, ‘তারা পারিবারিক বা সামাজিক চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। তবে কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে সেটি তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটি প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।’

এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন সিলেট জেলা কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও জুলাইয়ে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাবের ভাই আবুল আহসান জাবুরও। তিনিসহ সিলেটে এনসিপি থেকে ৯ জন পদত্যাগ করেন। গত ১২ জুলাই কমিটি ঘোষণার পরদিন বিশ্বনাথ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা কমিটি থেকে চার নেতা পদত্যাগ করেন। তাদের মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলা কমিটি থেকে সদস্য ফাহিম আহমদ ও যুগ্ম সমন্বয়কারী নাদিম মাহমুদ এবং বিশ্বনাথ উপজেলা কমিটি থেকে যুগ্ম সমন্বয়কারী রুহুল আমিন ও সদস্য শাহেদ আহম্মেদ পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া গত ২১ জুলাই গোয়াইনঘাট উপজেলা কমিটি থেকে আরও চার নেতা পদত্যাগ করেন। তারা হলেন—যুগ্ম সমন্বয়কারী এনামুল হক মারুফ, সদস্য তরিকুল ইসলাম, কিবরিয়া আহমদ ও কামরুল হাসান।

এর আগে দল গঠনের পরপরই এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেন দলটির তিন কেন্দ্রীয় নেতা যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) হানিফ খান সজীব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের। পদত্যাগপত্রে তারা ব্যক্তিগত কারণের কথা জানান এবং পদত্যাগের পর আগের দল গণঅধিকার পরিষদে ফিরে যান।

এদিকে, সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণ দেখিয়ে এনসিপির মাদারীপুর জেলা ও সদর উপজেলা সমন্বয় কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে মাদারীপুর জেলা কমিটির সদস্য মো. আব্দুল্লাহ আদিল ও রাতুল হাওলাদারের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সমন্বয় কমিটি গঠনের মাত্র দুদিন পর নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে তা স্থগিত করা হয়।

এনসিপির বিভিন্ন জেলা, উপজেলার কমিটির সদস্যরা পদত্যাগ করলেও তারা দলীয় কোনো নির্দেশনা মানেননি। পদত্যাগ পাঠানো হয়নি কেন্দ্রীয় দপ্তর সেলে। বেশিরভাগই পদত্যাগ করেছেন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে। এ বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো জেলা, উপজেলা কমিটির কারও কোনো পদত্যাগ আমি পাইনি। কারা ফেসবুকে পদত্যাগ করেছেন, সেটাও আমি জানি না।’

নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়ে এনসিপি দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক মোহাম্মদ রাকিব গণমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে মূলত এনসিপির সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। তাই জামায়াত-শিবিরের একটি অংশ এনসিপিতে থেকে যায়। পরে সুযোগ বুঝে তারা পদত্যাগ করে। বিএনপিপন্থি এমন কেউও থাকতে পারে। মূলত এনসিপিকে বিতর্কিত ও সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্যই তারা কমিটিতে থেকেছেন এবং পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য দ্রুত কমিটিগুলো করা হয়েছে। সে সময় খুব বেশি যাচাই-বাছাই করা হয়নি।

এদিকে আর্থিক কেলেঙ্কারি ও গুরুতর দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগর এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারী নিজাম উদ্দিনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক আন্দোলন বন্ধ করতে ৫ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নিজামের বিরুদ্ধে। গত রোববার সন্ধ্যায় এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর মঙ্গলবার তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। দলের এক নেতাকে মারধরের ঘটনায় এনসিপির রাজশাহী জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলামকে গত ২৭ জুন সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাকে কেন স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না, সে বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া শৃঙ্খলাভঙ্গ, নৈতিক স্খলন, বিতর্কে জড়ানোসহ বিভিন্ন ঘটনায় ১০ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গত ছয় মাসে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে এনসিপি।

শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগগুলো তদন্ত করে থাকে এনসিপির শৃঙ্খলা কমিটি। কেন্দ্রীয় এবং বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সদস্যদের নানান অভিযোগ দেখিয়ে পদত্যাগের বিষয়ে এই কমিটির প্রধান ও এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল-আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, অভিযোগ পেলেই আমরা প্রাথমিকভাবে শোকজ দিয়ে থাকি। এরপর জবাব পেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দিয়ে থাকি। এ ছাড়া শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে কমিটি বাতিল, বহিষ্কারের সুপারিশও আমরা করেছি। সব অভিযোগ আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি।

নেতাকর্মীদের পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, লোকাল পর্যায়ে এনসিপির নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অনেককে প্রেশারের মধ্যে রাখা হচ্ছে। যার ফলে কেউ কেউ এসব নিতে না পেরে বিভিন্ন চাপে পদত্যাগ করতে পারেন।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন কমিটি থেকে কারা পদত্যাগ করছেন, কেন করছেন বিষয়গুলো আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। যেসব অভিযোগ সামনে আসছে সেগুলো আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি গুরুত্ব সহকারে দেখবে। এরপর আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা মাত্র নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করেছি। এবার দেশব্যাপী সংগঠন গোছাতে আরও বেশি মনোযোগী হবো।

সূত্র : কালবেলা

  • এনসিপি
  • পদত্যাগ
  • হিড়িক
  • #