দেখতে দেখতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ৫০ বছর কেটে গেল! এবার দিনটি এসেছে ভিন্ন আবহে। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাসহ তাঁর দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী হয় দেশত্যাগ করেছেন, না হয় কারাগারে। গতবছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ মুজিবের সম্ভাব্য সকল স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা দেখা গেছে। যদিও শেখ মুজিব নিজে নিহত হয়েছেন আরও ৫০ বছর আগে।
ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও শেখ মুজিবুর রহমান সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না; ছিলেন না সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও। কিন্তু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার প্রধানরূপে। তিনি দুবারই ছিলেন সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর অভিযুক্ত আসামি। কিন্তু অভ্যুত্থানে এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভাবমূর্তি সর্বক্ষণই উপস্থিত ছিল। বস্তুত অভ্যুত্থানের লক্ষ্যগুলোর ভেতর একটি ছিল আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি। মামলাতে অন্যরাও অভিযুক্ত ছিলেন। তাদের ওপর, বিশেষত সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী সদস্যদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছিল। অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের তো অবশ্যই, শেখ মুজিবের প্রাণদণ্ডাদেশ হয় কিনা– তা নিয়ে বিশেষভাবেই উদ্বিগ্ন ছিল মানুষ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধারণাই করতে পারেনি– এই মামলার পরিণতি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অস্তিত্বে কত বড় আঘাত হিসেবে আসতে পারে। জনমনে ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল, মামলার মূল লক্ষ্যবস্তু শেখ মুজিব। তাঁর ‘অপরাধ’ তিনি বাঙালির পক্ষে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে অনেক গবেষণা ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে; প্রশাসক হিসেবে তাঁর সমালোচনাও কম নেই। কিন্তু সেসব রচনা এবং আত্মজৈবনিক রচনাগুলোতেও বাঙালির জাতীয় মুক্তির ব্যাপারে শেখ মুজিবের উপলব্ধি ও অঙ্গীকার স্পষ্ট। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরিণতিতে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়েছেন। সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একজীবনে তিনি জনপ্রিয়তার যে শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, অন্য কোনো বাঙালি নেতার পক্ষে সেখানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। যতই মুছে ফেলার চেষ্টা হোক; ইতিহাসে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবেই টিকে থাকবেন।
ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে চিত্তরঞ্জন দাশের ‘দেশবন্ধু’ উপাধি আজও টিকে আছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন চেয়েছিলেন বাঙালির রাজনীতিকে আগ্রাসী ভারতীয় রাজনীতি থেকে আলাদা করবেন; কিছুটা এগিয়েও ছিলেন। কিন্তু ১৯২৫ সালে তাঁর অকালমৃত্যুতে বাংলার রাজনীতির ওই স্বতন্ত্র ধারাটি আর টিকে থাকতে পারেনি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান স্রোতের বিপুলতার ভেতর হারিয়ে গেছে। হতাশাজনক সেই ঘটনার পরিণতি ঘটেছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগে।
দেশভাগের পরপরই বোঝা যাচ্ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি। মুক্তির জন্য মীমাংসা প্রয়োজন ছিল দুটি জরুরি প্রশ্নের; একটি জাতির, অন্যটি শ্রেণির। এই দুটি প্রশ্নে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সরব ছিল; কিন্তু দুই বুর্জোয়া দলের রাজনীতির দাপটে প্রশ্ন দুটি তাদের গুরুত্ব ধরে রাখতে পারেনি।
পূর্ববঙ্গের মানুষেরা যে নতুন একটি ঔপনিবেশিক শাসনের কবজায় পড়ে গেছে– এ ব্যাপারে অত্যন্ত সরব হয়ে উঠেছিলেন দুজন; মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। মওলানার বয়স বেশি, অভিজ্ঞতাও অধিক, তিনি ছিলেন সবার আগে; মুজিব এসেছেন পরে। প্রথমে তারা একসঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, যেটা অবধারিত ছিল। কারণ মওলানা ভাসানী জাতি ও শ্রেণি, এই উভয় প্রশ্নের মীমাংসার দাবি তুলেছিলেন। শেখ মুজিবের দৃষ্টি ছিল মূলত জাতি প্রশ্নের মীমাংসার ওপরেই।
মেহনতি মানুষদের দুঃখ শেখ মুজিব বুঝতেন। সে দুঃখে সর্বদাই তিনি কাতর থাকতেন। বাংলার মানুষের বঞ্চনা ও বেদনার কথা তিনি যেভাবে বলতেন, তাঁর বয়সী অন্য কোনো জাতীয়তাবাদী নেতা সেভাবে বলেননি। বাঙালির দুঃখ ঘোচানোর জন্য তিনি প্রয়োজন মনে করেছিলেন পাঞ্জাবি শাসনের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ। মওলানাও তা-ই মনে করতেন, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার কথা তিনিই প্রকাশ্যে সর্বপ্রথম তুলেছেন; কিন্তু জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে তিনি যুক্ত করতে চেয়েছিলেন মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে। শেখ মুজিবের অবস্থান ছিল ভিন্ন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের সেই অবিস্মরণীয় বক্তৃতাতে তিনি ঠিকই বলেছিলেন– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর বিবেচনায় পূর্ববঙ্গের জন্য দুটোই ছিল আবশ্যক, তবে প্রথমে প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতার। সেই লক্ষ্যেই তিনি লড়ছিলেন।
পাকিস্তানি শাসকেরা মুক্তির দাবির চেয়ে স্বাধীনতার দাবিকেই অধিক বিপজ্জনক মনে করত। কারণ মুক্তি জিনিসটা দূরবর্তী। সুদূরপরাহতও বলা চলে; কবে আসবে, জানা যায় না। আসবে কিনা, তাই-বা কে জানে! ৭ মার্চে শাসকদের শঙ্কা ছিল মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন কিনা তা নিয়ে। মুজিবের ওপর চাপ ছিল, বিশেষ করে ছাত্রদের; পাকিস্তানি শাসকেরা সেটা জানত। মুজিব যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না, এতে তাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। তারা ভেবেছে, আপাতত বিপদ তো কাটল, পরে দেখা যাবে কী হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে, বাহাত্তরের পর শেখ মুজিব শত্রু মনে করতেন বামপন্থিদের। বামপন্থিরা তাঁর বিরুদ্ধে ছিল বৈ কি। কিন্তু বিরোধিতাটা ছিল আদর্শিক রাজনৈতিক। তারা আন্দোলন করেছে; ষড়যন্ত্র করেনি। ষড়যন্ত্র করেছে তাঁর আশপাশের লোকেরাই। খন্দকার মোশতাক কমিউনিস্ট ছিলেন না; নন-কমিউনিস্ট। বড়াই করে বলতেন, তিনি হচ্ছেন অ্যান্টি-কমিউনিস্ট। সেই অ্যান্টি-কমিউনিস্টরাই ষড়যন্ত্র করেছে এবং হত্যা করেছে শেখ মুজিবকে। কারণ তারা চাইছিল বাংলাদেশকে পরিণত করবে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে; মুজিব সেই কাজে ঠিকমতো সহযোগিতা করছিলেন না। তাই তারা তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে। মধ্যবিত্তের যে অংশ অত্যন্ত স্ফীত হয়েছিল, শেখ মুজিব যাদেরকে তাঁর অনুকরণীয় ভাষায় বলেছিলেন, ‘চাটার দল’, তারা এতটা ভারী হয়ে পড়েছিল যে নড়াচড়া করতে পারেনি। যেটুকু করেছে সেটুকু আত্মরক্ষার জন্য, কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে হাত মিলিয়েছে ঘাতকদের সঙ্গে।
ঘাতকরা বলত, তারাও মুক্তিযুদ্ধের লোক; নাকি তারাও অংশ নিয়েছিল ওই যুদ্ধে। হয়তো নিয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আদৌ বিশ্বাস করত না। রাষ্ট্রকে তারা চালিত করতে চেয়েছিল বিপরীত দিকে। ভিন্ন নামে আরেকটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল তারা। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রের পথাভিসারী বাংলাদেশ তাদের জন্য অসহ্য ছিল। নিজেরা ধার্মিক ছিল না মোটেও; ধর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল আচ্ছাদন হিসেবে; যেমন চেয়েছিল তাদের পাকিস্তানি প্রভু ও পূর্বসূরিরা। ঘাতকের পেছনেও ঘাতক ছিল। ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ। মওলানা ভাসানী যে শত্রুদের কথা বলতেন।
শেখ মুজিবের অনুরাগীর অভাব ছিল না। অনুরাগ প্রকাশ করত সুবিধার আশায়। প্রকৃত অনুরাগী তারাই যারা তাঁকে দেখে জনগণের নেতা হিসেবে। মুজিববাদের কথা বাহাত্তরের পরে শোনা যেত, এখন যায় না। মুজিববাদীরা শেখ মুজিবের মিত্র ছিল না। তাঁর সঙ্গে এরা যা করেছে সে-কাজটা মিত্রের বেশে শত্রুতা। শেখ মুজিবের প্রকৃত অনুরাগী তারাই, যারা তাঁকে জনগণের নেতা হিসেবে চেনে এবং বাহাত্তরের পর থেকে তারা ক্রমবর্ধমান জনবিচ্ছিন্নতার কথা স্মরণ করে দুঃখ পায়। শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মুনাফার রাজনৈতিক ব্যবসা করেছে তাঁরই দল এবং দলীয় লোকজন।
শেখ মুজিব যে-জাতীয়তাবাদের নেতা ছিলেন– মনে হয়েছিল যাবেন তিনি গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ পর্যন্ত। তিনি থেমে গেছেন কিংবা তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুটোই সত্য। কিন্তু তিনি থাকবেন। মহাকাব্যের এই নায়কের মৃত্যু নেই। ভিন্ন নায়কেরা হয়তো আসবেন, ভিন্ন রূপে। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে দিয়ে নয়, তাঁর কাজটা যেখানে এসে থেমে গেছে, সেখান থেকে ওই ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদকে শত্রু হিসেবে চিনে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(সমকাল থেকে নেওয়া)