পরিবার ও নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে হত্যা করতে চায়। বিদেশ থেকে কিছু ইউটিউবার বিশেষ করে ফ্রান্স থেকে কয়েক দিন আগে দুজন ইউটিউবার অর্ডার দিয়েছেন, আমাকে হত্যা করার জন্য। কাল রাতে বা পরশু রাতে দেখলাম এঁরা সবাই জামায়াতের লোক।’
জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশ্নে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করে আসছিলেন কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এই এমপি। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে নিয়মিত কথা বলতে দেখা যায় তাঁকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ সরব তিনি। এদিকে মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকে শোকজের জবাব দিতে আরো ২৪ ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি।
এ পরিস্থিতিতে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ফজলুর রহমান গতকাল সোমবার দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘হে বাংলাদেশের মানুষ, আমি তো আজ থেকে ৫৪ বছর আগে আপনাদের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আজ যে সন্তানেরা আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, তোমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করার জন্য আমি যুদ্ধ করেছিলাম। তোমাদের কাছ থেকে কি অপমৃত্যুটা আমার কাম্য?’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘যদি আমার কোনো কথায় তোমরা মনে করো আমি দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছি বা তোমাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলছি, আমার বিরুদ্ধে মামলা করো, আমাকে গ্রেপ্তার করো, আমাকে শাস্তি দাও। কিন্তু আমাকে হত্যা করার জন্য আমার বাসা পর্যন্ত মব সৃষ্টি করো, যেটা গত এক বছর যাবৎ বাংলাদেশে, এই পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশে সবচেয়ে কুখ্যাত নাম মব, সেই মব জাস্টিস আমার ওপর চলতে পারে কি না এবং চলবে কি না, সেটা আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
এর পাশাপাশি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে ল রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ফজলুর রহমান। এ সময় তাঁর স্ত্রী ও ছেলেও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ফজলুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ, আপনারা জেনে রাখুন, আমার জীবন বড় শঙ্কায় রয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমি একজন মানুষ। আমার অধিকার আছে বেঁচে থাকার।’
এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলেন, ‘জিডি করব না, মাইরা ফেললেও জিডি-টিডি কিছুই করব না।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমার জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপার বলে গেলাম। আমার এ দেশে বাঁচার অধিকার আছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখন আমার বাসার সামনে গিয়ে যেগুলো হচ্ছে, আপনাদের মাধ্যমে জাতিকে, দেশকে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে জানিয়ে গেলাম।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘ছেলেরা বা ছাত্ররা যদি মনে করে, অন্য দলের লোকেরা যদি মনে করে, আমি জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোকজনের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, এটা আমি বলব। এতে যদি আমার কথার মধ্যে কারো প্রতি কোনো ধরনের অসম্মান করে থাকি, আঘাত করে থাকি, তারা মনে করে, তাহলে তারা রাজনৈতিকভাবে এটার জবাব দেবে, আমি তাদের জবাব দেব। এটার জন্য তো পরস্পরকে হত্যা করার ব্যাপার নেই। বাসার সামনে মব করার তো দরকার নেই।’
এর আগে সংবাদ সম্মেলনে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আজ (সোমবার) হঠাৎ করে যেটি দুর্ভাগ্যজনক, আমার বাসার সামনে কিছু মিছিলের শব্দ পাইলাম। সেই শব্দগুলো বলাটাও আমার কাছে মনে হইল, কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার সন্তানের সমান। এরা কারা, আমি চিনিও না। এরা স্লোগান দিল আমার নামে, ফজু পাগলাকে গ্রেপ্তার করো…ইত্যাদি ইত্যাদি। ফজু পাগলা মানে আমি বাংলাদেশে এখন ফজু পাগলা হয়ে গেছি। এই নামটা আমাকে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী। আমি নাকি ফজু পাগলা। প্রথম এই কথাটা বলেছেন, মুফতি আমির হামজা নামের একজন লোক। এই ছেলেপেলেরাও আমার নামে ফজু পাগলা স্লোগান দিয়েছে, আমি বাংলাদেশের একজন পাগলা। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা আমাকে হত্যা করতে চায়। আমাকে মারতে চায়, তারা আমার বাসার সামনে যেভাবে গিয়ে মব সৃষ্টি করেছে… আমি দেখছি, এক বছর যাবৎ ৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের কিছু সন্তান মব সৃষ্টি করে তাদের দাবি-দাওয়া বলেন, আর যা-ই বলেন, আমার মতো একজন সিনিয়র মানুষ যে দেশটার জন্য যুদ্ধ করেছি, আমি যুদ্ধ না করলে বা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ না করলে এই সন্তানেরা তো বাংলাদেশের সন্তান হইত না, এরা হইত পাকিস্তানের সন্তান। আমাদেরকে হত্যা করা বা আমাদের নামে বিশ্রী স্লোগান দেওয়া বা আমি একটা ভাড়া বাসায় (সেগুনবাগিচার কনকর্ড টাওয়ার) থাকি, এটা নিজের কোনো বাসা না।’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করতাছি, আমি যে ভাড়া বাসায় আছি, যেভাবে গিয়ে আমার সঙ্গে মব সৃষ্টি করা হইছে, বাসায় আমাকে থাকতে দেবে কি না?…মালিক বলতে পারেন, ভাই, আপনাকে বাসা ভাড়া দিলে আমার বাড়িঘর পুইড়া ফেলবে, যেইটা করতাছে মব। আমি আমার জীবন নিয়ে চিন্তিত যতটা, তার চেয়ে আমার স্ত্রী দেখেন বসে আছেন। আমার সন্তানেরাও ওখানে থাকে। দুই সন্তান আমার সঙ্গে থাকে। তাদের তো কোনো অপরাধ নেই। একজনের বাসা পর্যন্ত গিয়া মব সৃষ্টি করা যেটি বাংলাদেশে হচ্ছে, সেটি ন্যায়ভিত্তিক মনে করেন কি না?’
বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার জীবন, আমি কোনো ভয় করি না। মৃত্যুকে আমি কোনো দিন ভয় করি না। কিন্তু অপমৃত্যু আমার কাছে সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক। আমার কাছে মনে হচ্ছে, দেশ-বিদেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির যাঁরা ইউটিউবার এবং যাঁরা তাদের পক্ষে সাংবাদিকতা করেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে দেশ-বিদেশে থেকে বেশ কয়েক দিন যাবৎ প্রথম বলছেন, ফজলুর রহমানকে মব জাস্টিস করো, তাঁর ওপর মব জাস্টিস এখন প্রযোজ্য। ফ্রান্স থেকে দুজন সাংবাদিক বলেছেন, তাঁকে হত্যা করাই দরকার। জামায়াতের একজন ইউটিউবার বলেছেন, ফজলু পাগলাকে জবাই করেই হত্যা করতে হবে। এই যে অবস্থা, এই অবস্থাটা জানানোর জন্য আমি আপনাদের কাছে এসেছি। তার রেজাল্ট দেখছি, আমার বাড়ির সামনে সাত-আট বা ৯ জন ছেলেমেয়ে, তারা কারা, কোন দলের; আমি চিনি না।’
‘এই যে অবস্থা, এই অবস্থায় আমি তো বাংলাদেশের একজন নাগরিক; আমার তো বাঁচার অধিকার আছে’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রথমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে হাত জোড় করে আহবান জানাব, আমি বাংলাদেশের ফজলুর রহমান। আমি হাত জোড় করে জানাব, আমি একজন মানুষ। আমি হাত জোড় করে আপনাদের কাছে, জনগণের কাছে বলতে চাই, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার বাঁচার অধিকার এ দেশে আছে, এটা আমি মনে করি। এটা আপনারা মনে করেন কি না? কিন্তু আপনারা কি মনে করেন, এভাবে আমাকে হত্যা করলে পরে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের যে অবস্থা, সে অবস্থাটা কি এ রকমই থাকবে? আমাকে হত্যা করা উচিত বলেই কি আপনারা মনে করেন? আর আমার দলকে আমি বলব, এই কথাটা দল আমাকে একটা শোকজ করতেই পারে, আমি উত্তর দেব। এটা দলের সঙ্গে আমার ব্যাপার, তখন দেখা যাবে। কিন্তু আমাকে হত্যা করার জন্য যারা এলো, আমি তাদের চিনি না, জানি না। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কও নেই। তাদের সঙ্গে আমার শত্রুতাও নেই। আমার কোনো মিত্রতাও নেই।’
সংবাদ সম্মেলনে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণকে আবারও প্রশ্ন করতে চাই, এ দেশে আমার বাঁচার অধিকার আছে কি না? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে আমার স্ত্রী যোগোযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসেছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। আমি শুনেছি আর্মিও এসেছে। তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু পুলিশ আর আর্মি আসাই কি আমার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে আমার জন্য খুব সম্মানজনক ব্যাপার। যারা আমাকে বাঁচাইতে চাইবে যে পুলিশ-আর্মি গার্ড করবে, আমি একা একা দেশে চলতে পারব না?’