সম্পর্ক, সমাজ ও মনস্তত্ত্ব : পুরুষের অতীত কি প্রাসঙ্গিক?

: সৌরভ হাছান হিমেল
প্রকাশ: ১৫ ঘন্টা আগে

একটি বহুল চর্চিত সামাজিক প্রশ্ন হল, ‘একজন পুরুষের অতীত’ বিশেষত তার সম্পর্ক ও যৌন ইতিহাস নারীদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আমরা যখন নারী-পুরুষ সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি, বিয়ের যোগ্যতা ও মানবসমাজে গৃহীত নৈতিকতার দিকে নজর দেই, তখন প্রশ্নটি আরও জটিল এবং বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। একদিকে ধর্মীয় ও নৈতিক বিবেচনায় উভয় লিঙ্গেরই চরিত্রগত শুদ্ধতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সমাজ ও বিজ্ঞানের চোখে বিষয়টি একটু ভিন্ন রূপ নেয়। আগে বুঝতে হবে নারী ও পুরুষের মনস্তত্ত্ব সমান নয়

নারীর মস্তিষ্কে বিশেষত limbic brain structure ও hormonal response mechanism পুরুষের মতো চিন্তা বা পছন্দের ধরন তৈরি হয় না। নারীদের ক্ষেত্রে হাইপারগ্যামি একটি শক্তিশালী ইভোলুশনারি ইন্সটিংক্ট। হাইপারগ্যামি মানে হচ্ছে একজন নারী এমন সঙ্গী খোঁজে, যার সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক কিংবা মানসিক অবস্থান তার চেয়ে সমান বা উঁচু হবে। নারী এমন পুরুষকেই আকর্ষণীয় মনে করে যার কাছে নিরাপত্তা , সম্পদ এবং সামাজিক স্ট্যাটাস আছে বা থাকার সম্ভাবনা আছে। সেই প্রেক্ষিতে পুরুষটি অতীতে কতটা সম্পর্কের মধ্যে ছিল বা কী করেছে, প্লে বয় ছিল কি-না সেটা তাদের কাছে বড় বিষয় নয়, অতটা মেটার করে না যতটা পুরুষের করে বরং সেই পুরুষ এখন কী দিতে পারে, ভবিষ্যতে কেমন হবে সেটাই মূল বিবেচ্য।

বিবর্তনমূলক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, হাইপারগ্যামির শিকড় নিহিত রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক মানবসমাজে। একজন নারী শারীরিকভাবে সন্তান ধারণ ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অধিক ঝুঁকি ও সম্পদের প্রয়োজনীয়তার মুখোমুখি হন। ফলে, এমন একজন পুরুষ বেছে নেওয়া যিনি শিকার করতে পারেন, রক্ষা করতে পারেন, খাদ্য-আহার ও নিরাপত্তা দিতে পারেন—এটি নারীর প্রাকৃতিক পছন্দে পরিণত হয়। মনোবিজ্ঞানী ডেভিড এম. বুস (David M. Buss) তাঁর ‘The Evolution of Desire’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নারীরা গড়পড়তা পুরুষদের তুলনায় উচ্চ আয়ের, সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ও শারীরিকভাবে সুগঠিত পুরুষদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন, এবং এটি একটি আন্ত-সংস্কৃতিক প্রবণতা। তবে হাইপারগ্যামি মানসিক পরিপক্বতা, নেতৃত্বদক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের সফলতার ইঙ্গিতও বহন করে। অনেক সময় নারীরা এমন পুরুষের প্রতিও আগ্রহ দেখান, যিনি বর্তমানে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী না হলেও তার মধ্যে ভবিষ্যতে ‘উন্নতি’ লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, পুরুষের ‘potential value’ বা ‘trajectory of growth’ নারীর পছন্দে মুখ্য ভূমিকা রাখে।

সমাজবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে, নারীর হাইপারগ্যামি আচরণটি রাজনীতি, মিডিয়া বা কর্মক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয়তা, খ্যাতি বা সামাজিক প্রভাববিস্তারকারী পুরুষদের (যেমন সেলিব্রিটি, রাজনীতিক, সফল উদ্যোক্তা) নারীসঙ্গ বেশি হয় এবং তাদের প্রতি নারীর আকর্ষণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। মনোবিজ্ঞানী গ্যাড সাদ (Gad Saad) বলেন, “হাইপারগ্যামি নারী মনে একধরনের স্নায়বিক সংকেত তৈরি করে—এই পুরুষের সঙ্গে মিলনে তার জিনগত উত্তরাধিকার এবং সন্তানদের জীবনের মান উন্নত হবে।” একটি টার্ম আছে, ‘pre-selection bias’ অর্থাৎ নারীরা অবচেতনভাবে এমন পুরুষকে বেশি আকর্ষণীয় মনে করে, যাকে অন্য নারীরাও চায়। এটি সারভাইভাল কলাকৌশল। যদি কোনো পুরুষ অতীতে বহু নারীর পছন্দের পাত্র ছিল, তাহলে নারীরা ধরে নেয় যে সে নিশ্চয়ই কিছু গুণসম্পন্ন। এটা সেই পুরুষকে সামাজিকভাবে ‘হাই ভ্যালু মেইল’ হিসাবে প্রমাণ করে। উদাহরণসরূপ হাল আমলের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব সালমান মুক্তাদির। সে যখন পরিবর্তিত হয়ে ‘ফ্যামিলি ম্যান’ হয়, তখন নারীরা তাকে ‘দায়িত্ববান’ ও ‘আকর্ষণীয়’ মনে করে। কিন্তু ইতিহাস ও বায়োলজি দেখলে দেখা যাবে পুরুষের ক্ষেত্রে অতীত মেটার করে নারীর।

রোমান সমাজে, নারীর কৌমার্য রক্ষা করা হতো ‘vestal Virgins’ এর মাধ্যমে। Vestal Virgins ছিলেন প্রাচীন রোমান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘Vestalia’-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য অংশ, যারা দেবী Vesta-র উপাসনা করতেন। দেবী ভেস্টা ছিলেন গৃহের আগুন, পারিবারিক ঐক্য ও শুদ্ধতার দেবী। Vestal Virgins ছিলেন সেই পবিত্র কুমারী পুরোহিতেরা, যাঁদের কাজ ছিল দেবীর মন্দিরে চিরন্তন আগুন জ্বালিয়ে রাখা, কারণ এই আগুন রোমের নিরাপত্তা, ঐক্য এবং অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত। এই নারীরা সাধারণত ৬ থেকে ১০ বছর বয়সের মধ্যে সম্ভ্রান্ত প্যাট্রিসিয়ান পরিবার থেকে নির্বাচিত হতেন। ভেস্টাল ভার্জিনদের সামাজিক মর্যাদা ছিল অত্যন্ত উচ্চ। তারা রাজকীয় মর্যাদায় চলাফেরা করতেন, আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারতেন (যা নারীদের জন্য সাধারণত নিষিদ্ধ ছিল), এমনকি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির প্রাণভিক্ষাও চাইতে পারতেন। রোমান সাম্রাজ্যের অন্য যেকোনো নারীর চেয়ে তাদের বেশি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আইনি অধিকার ছিল। একবার ভেস্টাল হিসেবে নির্বাচিত হলে তাদেরকে ৩০ বছরের জন্য কৌমার্য পালনের শপথ নিতে হত। এই সময়ের মধ্যে তারা বিয়ে করতে পারতেন না, যৌনসম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা—যদি কেউ এই শর্ত ভঙ্গ করতেন, তবে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যা ছিল রোমান আইনে সর্বোচ্চ ধর্মদ্রোহমূলক শাস্তি।

অথচ পুরুষদের বহুগামীতা ছিল সামাজিকভাবে স্বীকৃত। চীনাদের কনফুসিয়াস দর্শনে, নারীর ‘সতীত্ব’ পরিবার, বংশ ও সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার অংশ ছিল। সতীত্ব রক্ষার আদর্শে চীনে ‘chaste widow’ বা সতী বিধবার ধারণা গড়ে ওঠে, যারা স্বামী মারা যাওয়ার পর পুনরায় বিয়ে না করে সারা জীবন সতীত্ব বজায় রাখতেন। ১৪শ শতক থেকে মিং রাজবংশ (Ming Dynasty) এই আদর্শকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপ দেয়। সতী বিধবাদের সম্মানে তোরণ (paifang) নির্মাণ হত, তাদের বংশের জন্য কর মওকুফ দেওয়া হতো। পুরুষের যৌন অতীত কোনো বড় বিষয় ছিল না। পুরুষদের জন্য নারীর অতীত ম্যাটার করে, এবং তা ডিএনএ পর্যায়ে। এর মূল কারণ ‘paternal uncertainty’, অর্থাৎ সন্তান তার কিনা—এটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো প্রাকৃতিক উপায় পুরুষের নেই। ফলে, পুরুষের জেনেটিক গঠন ও সমাজের বিবর্তন তাকে নারীর সতীত্ব ও একনিষ্ঠতা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন করে তোলে। পুরুষ বায়োলজিকালি বীজবপনকারী এবং নারী বীজ গ্রহণকারী। এজন্য নারী যদি বহু পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখে, তাহলে সন্তান কার—সে বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়। কিন্তু নারী জানে যে সন্তান তারই শরীরেই গঠিত হচ্ছে, সুতরাং তার জন্য maternity certainty বা মাতৃত্বের নিশ্চয়তা শতভাগ। পুরুষ এই নিশ্চয়তা পায় না, তাই সে ‘sexual exclusivity’ বা যৌন একনিষ্ঠতা চায়।

সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকে পুরুষের অতীত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সামাজিক ও সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে না। পুরুষের অতীত নারীদের কাছে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নারীর অতীত পুরুষের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অতএব, সমাজে পুরুষের অতীত বিচার হয় না মানে এই নয় যে তা একেবারেই গুরুত্বহীন। বরং তা প্রাসঙ্গিক নয়, যতক্ষণ না তা তার ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

  • নারী
  • পুরুষ
  • যৌন
  • সম্পর্ক
  • #