রাজধানীর কলাবাগান থানার ফাস্ট লেন এলাকায় স্ত্রীকে হত্যা করে ডিপ ফ্রিজে লাশ রাখার নেপথ্যে শশুর বাড়ির জমি লিখে না দেওয়ার ক্ষোভ রয়েছে বলে দাবি করছেন নিহতের স্বজনরা। ছিলো স্ত্রীর পরকীয়ার সন্দেহ, যদিও নিহত তাসলিমা ব্যবহার করতেন না মোবাইল ফোন। পারতেন না বাসা থেকে বের হতে।
স্বামীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার গৃহবধু তাসলিমা আক্তারের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ঘাতক নজরুল ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাসলিমাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে ফ্রিজের মাছ ও মাংসের প্যাকেটের আড়ালে চাপা দিয়ে রাখে। রবিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা পুলিশের। পরবর্তীতে স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ডিপ ফ্রিজ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার সকালে কলাবাগানের ফাস্ট লেনের ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, চার মাস আগে নজরুল ইসলাম স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এই বাসায় ভাড়া ওঠেন। তার তিন মেয়ে থাকলেও বাসায় বড় মেয়ে নাজনিন আক্তার (১৯) ও মেজো মেয়ে নাজিফা ইসলাম (১২) কে রাখতেন। ৫ বছর বয়সী ছোট মেয়ে নিশাত আনজুন থাকতো নানা-নানির কাছে। স্ত্রীকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিতেন না। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রেখেছেন দুই মেয়ের পড়াশোনা।
নজরুলের বাসার নিরাপত্তারক্ষী বাবুল হাওলাদার বলেন, সোমবার সকাল ৮টা ১ মিনিটে দুই মেয়েকে নজরুলের ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হন। এরপর আর ফিরে আসেননি। এর আগে রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাড়ি নিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন।
তিনি আরও বলেন, নজরুল ইসলাম ৬ তলার একটি ফ্ল্যাটে চার মাস আগে ভাড়া এসেছেন। স্ত্রী-সন্তানদের তেমন বের হতে দেখা যায়নি। তারা কখনো বের হলে নজরুল ইসলাম সঙ্গে করে নিয়ে বের হতেন। তাদের কখনো স্কুল-কলেজে যেতে দেখিনি।
ভবনের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চার মাস আগে তারা যখন এসেছেন তখন দেখেছিলাম ট্রাক ভর্তি আসবাবপত্র নিয়ে আসছেন। ট্রাকে থাকা সকল আসবাবপত্র একদম নতুন। এরপর তার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি। গতকাল এই ঘটনা জানাজানির পর তার বিষয় জানলাম যে, দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী-সন্তানদের নির্যাতন করতেন। তাদের বাসায় বন্দী করে রাখতেন। মোবাইল ব্যবহার করতে দিতেন না। এমন কি তিনি বাসা থেকে বের হলে গেটে তিন থেকে চার চারটি তালা মারতেন। অবাক করার বিষয় হলো ওই ব্যক্তি বাসায় ওঠার পর দরজার পুরনো তালা বদলে নতুন তালা লাগিয়েছেন। সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করেছেন। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো।
ডিপ ফ্রিজ থেকে তাসলিমার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তার ছোট ভাই নাঈম হোসেন বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি তদন্ত করছেন থানার উপ-পরিদর্শক আতিকুর রহমান। ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি এটি পারিবারিক কলহ ও স্ত্রীকে সন্দেহ থেকে হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা কাজ করছি এখনই বিস্তারিত বলা যাবে না।
এ দিকে নিহত তাসলিমাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার চিত্র ফুটে উঠেছে পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে। ২১ বছর ধরে সংসার করা তাসলিমাকে ঘাতক স্বামী নজরুল ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।নিহতের মাথায় অন্তত চারটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রতিটি আঘাতের ক্ষত ৫ থেকে ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর ছিলো। এমন কি আঘাতে কারণে নিহতের মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে। এরপর গামছা ও বিছানার চাদর দিয়ে পেচিয়ে ডিপ ফ্রিজের ভেতরে রেখে তার ওপর মাছ ও মাংসের প্যাকেট দিয়ে চাপা দেয় ঘাতক।
বোনের লাশের অপেক্ষায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে অপেক্ষারত নিহতের বড় ভাই নাজমুল হোসেন সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার বোনের হাজবেন্ড নজরুল ইসলাম আগে কাপড়ের ব্যবসা করত। এরপর সে ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেয়। বর্তমানে সে কিছুই করত না। আদাবরে নিজের বাড়ি ছিল, সেসবও বিক্রি করে দেয়। এরপর সে আমার বোনকে চাপ দিতে থাকে গাজীপুরের পূবাইল এলাকা থেকে তাকে ১০ কাঠা জমি লিখে দিতে হবে। আমরা তাকে সম্পত্তি লিখে দিতে রাজি ছিলাম না। আমরা তিন ভাগ্নি ও বোনকে পাঁচ কাঠা জায়গা লিখে দিব কিন্তু সে মেনে নেয়নি। এরপর সে তার বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। পরবর্তীতে তিন দিন আগে নজরুল আমার বাবা-মাকে ফোন করে বলে আমি অনেক অসুস্থ আমাকে দেখতে আসেন। তারা গেলে সে আমার বাবা মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণের জন্য ক্ষমা চায়।
হত্যার ঘটনার বিষয়ে তিনি জানান, গত সোমবার সকালে আমার দুই ভাগ্নিকে নজরুল ইসলাম জানায় তার মা অন্য আরেকজনের সাথে পালিয়ে গেছে। ভাগ্নিরা বাসার সব রুমে খোঁজাখুঁজির পরে নজরুলের রুমে গিয়ে রক্ত দেখতে পায়। কিন্তু তারা ভয়ে কিছু বলেনি। পরে তাদের দুজনকে নিয়ে আদাবরের মনসুরাবাদ এলাকায় নজরুলের বোনের বাসায় রেখে আসে। এরপর গতকাল দুপুর ২টার দিকে ভাগ্নিদের ফুফু আমাকে ফোন দিয়ে জানায় আপনার বোনের মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে আপনি দ্রুত ঢাকায় আসেন। পরে আমি গাজীপুর এসে দুই ভাগ্নিকে নিয়ে কলাবাগান থানায় যাই। পরে পুলিশ নিয়ে বাসায় গিয়ে দেখতে পাই দরজা বন্ধ। এরপর দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমার বোনকে পাই না কিন্তু বিছানায় রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছিল। পরবর্তীতে ডিপ ফ্রিজ খোলার পরে দেখা যায়, আমার বোনের লাশের ওরপ উপর দিয়ে অনেক মাছ গোশত দিয়ে ঢেকে রাখা। সেগুলো সরানোর পরে আমার বোনকে দেখতে পাই। এটা দেখার পরে বেহুশ হয়ে যাই।
স্ত্রী-সন্তানদের ওপর নজরুলের নির্যাতনের বিষয়ে তিনি নিহতের ভাই আরও বলেন, আমার বোনকে সে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিত না। বড় ভাগ্নি এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর তার পরে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে। মাদ্রাসায় হেদায়েতুন নহমি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এরপর থেকে তার লেখাপড়া বন্ধ। মেজ ভাগ্নিও ক্লাস ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার পরে তার লেখাপড়াও বন্ধ করে দেয়। আর ছোট ভাগ্নি আমাদের কাছে গাজীপুরে থাকত, সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে।
নাজমুল অভিযোগ করে বলেন, এই জমি তার নামে লিখে না দেওয়ায় আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে হাত-পা বেঁধে ডিপ ফ্রিজের মধ্যে রেখে দেয়। সে কতই না নৃশংস ভাবে আমার বোনকে হত্যা করেছে। এই ঘটনার পর থেকে সে তার মোবাইল একবার ওপেন করে আবার বন্ধ করে এবং সে বর্তমানে পলাতক রয়েছে। আমার বোনকে যেভাবে সে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
গৃহবধুর লাশ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের (নিউমার্কেট-কলাবাগান) জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। আমরা আসামিকে গ্রেফতারে কাজ করছি। আসামিকে গ্রেফতারের পর হত্যার বিষয় বিস্তারিত বলা যাবে।