ছবি : মযহারুল ইসলাম বাবলা
মযহারুল ইসলাম বাবলা একজন চিন্তক ও প্রাবন্ধিক। তিনি সমাজ, রাষ্ট্র-কাঠামো কিংবা আমাদের নানা অসংগতি নিয়ে সব সময় সোচ্চার থাকেন। তিনি অন্যায়কে অন্যায় আর সত্যকে সত্য বলতে পিছপা হন না। সমাজের মানুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন-এই জনগণ নামের সাধারণ মানুষের নিষ্পেষিত জীবনচিত্র। ক্ষমতা আমাদের কিভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে তাও তিনি তাঁর লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধনে বারংবার আমাদের বলবার চেষ্টা করেছেন। মযহারুল ইসলাম বাবলা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালে ৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডুর উত্তর সলিমপুর। বাল্যকাল থেকেই তাঁর বেড়ে ওঠা ঢাকাতে। সচেতনভাবে জাতীয়তাবাদী, বাম প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামের সাথে তিনি নিজেকে যুক্ত করে তুলেছেন। রাজনীতি সচেতন ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তিনি নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছেন- যে কারণে সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে তিনি হাতে তুলে নিতে পারেন কলম। নাট্যসংস্কৃতি আন্দোলনের প্রত্যক অংশগ্রহণের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় মতাদর্শিক রাজনৈতিক চেতনায় সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠায় সংস্কৃতির নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি যুক্ত। তিনি নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে চলেছেন জাতীয়, দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সাময়িকীতে।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘দূরে, তবু দূরে নয়’, ‘কালের কড়চা’, ‘সমাজ রাজনীতির সেকাল একাল’। ‘সমাজ রাজনীতির সেকাল একাল’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। প্রকাশ করেন কথাপ্রকাশ। এই গ্রন্থে তিনি আমাদের ইতিহাসের নানা পর্বের ঘটনা, জীবনস্মৃতি এবং সমকালকে ধারণ করেই সতেরটা প্রবন্ধ দিয়ে বইয়ের সূচি সাজিয়েছেন। অপ্রত্যক্ষ বিষয় ও ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা মূর্র্ত হয়েছে এই গ্রন্থ রচনায়। এই গ্রন্থের ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে- ‘আমাদের ক্রান্তিকালের শুরু কবে থেকে তার সঠিক সময় কাল বলা অসম্ভব। শত সহস্র বছরব্যাপী ভূখণ্ডের ইতিহাসে নানা পর্বের উত্থান-পতন, ত্যাগ-আত্মত্যাগেও আমাদের ক্রান্তিকালে অবসান ঘটেনি, এটা নির্মম সত্য। আমরা অনাদিকাল একই বৃত্তে আটকে আছি। আমাদে সমষ্টিগত জীবনের কোন শুভ পরিবর্তন সূচিত হলো না। পরিবর্তন কেন ঘটেনি? সেটা অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিশ্চয়ই নয়? নির্দিষ্ট ভাবে বলা যায় আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন না ঘটা। অর্থাৎ সমাজ বিপ্লব সংঘটিত না হওয়া। হাত বদল ঘটেছে কেবলই ক্ষমতার। শাসক বদলের ধারাবাহিকতায় স্বজাতি শাসকের ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু শাসকদের চরিত্রের একটা বদল ঘটেনি। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণির করতলগত। সংখ্যালঘু শাসকদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রের সকল সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের নিরঙ্কুশ অবস্থান ও আনুগত্যে শাসকেরা শক্তিতে-দৌরাত্ম্যে অপ্রতিরোধ্য। রাষ্ট্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যবহার পরিবর্তন তো পরের কথা; শক্ত-পোক্তভাবেই সাবেকি ব্যবস্থা অটুট থেকেছে। সে কারণে রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি অতীত অবস্থায় বিরাজমান। রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। রাষ্ট্রের সকল অনাচারের মাশুল গুনছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। রাষ্ট্রের ছড়ি হাতে শোষণ নিপীড়ন লুণ্ঠনে মত্ত শাসকেরা। আমাদের শাসকশ্রেণি লুণ্ঠনে এবং লুণ্ঠিত অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচারে সিদ্ধহস্ত। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ লুণ্ঠনে প্রতিভূরূপে দেশের সম্পদ স্বার্থ তুলে দিতেও কার্পণ্য করে না। দেশপ্রেম বলে তাদের কিছু আছে তেমনটি অনুমান করাও যাবে না। আমরা নিশ্চয় বিদ্যমান এই অপব্যবস্থার থেকে পরিত্রাণ চাই। সেটা সম্ভব হবে সমষ্টিগত মানুষের ঐক্য- সংহতিতে। সামষ্টিক ঐক্যই সম্ভব প্রতিপক্ষকে পরাভূত করা। এবং সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করা। তাই সমষ্টিগত মানুষের ঐক্যের বিকল্প নেই।’
ধর্ম এবং বর্ণবাদ নিয়ে মযহারুল ইসলাম ত৭ার লেখাপ্রবন্ধগুলোতে সচেতনতার কথা উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে রাজনীতি হয় এই ধর্ম নিয়েÑকারণ সহজ সরল জনগণ সহজেই ধর্মের কথা বললে তারা তাদের ধর্মভীরুতাকে প্রকাশ করেন। এই সুযোগকে সমাজের সুবিধাভোগী বা আধিপত্যবাদীরা কাজে লাগিয়েছেনÑনিজেদের স্বার্থে। সমাজের উপর আধিপত্যবাদী শ্রেণি নিজেদের আধিপত্য বজায় ও বিস্তারের এবং শ্রেণিশোষণকে নিষ্কণ্টক ও স্থায়ী বৈধতা দানের অভিলাষেরই বর্ণাশ্রম প্রথাকে ধর্মী অনুশাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আমাদের সাহিত্যেও জাত-পাতের অনেক তথ্য শুনতে পাই। সকল যোগ্যতা থাকার সত্ত্বেও জাত-পাতের কারণে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এই জাত-পাত নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন সন্ত কবীর। সাধক লালনও জাত নিয়ে অনেক গান রচনা করেছেন এবং বলেন জাত যদি ধরতে পারতেন তাহলে আগুন দিয়ে তা পোড়াতেন। সাহিত্যেও অনেক সাহিত্যিক এই নিম্নজাতের মানুষদের নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাদের কথায় মযহারুল ইসলাম তাঁর ‘জাতপ্রথার শ্রেণিশোষণ’ প্রবন্ধে বলেছেন। জেলে সম্প্রদায়ের নানা বঞ্চণা-জীবন সংগ্রাম নিয়ে অনেকেই লিখেছেন তাদের মধ্যে- অদ্বৈতমল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, সত্যেন সেনের- ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের- ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছাড়াও এই সম্প্রদায় নিয়ে আরও লিখেছেন- অমরেন্দ্র ঘোষের- ‘চরকাশের’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহিন গাঙ’, শামসুদ্দিন আবুল কালামের- ‘সমুদ্রবাসর, আবু ইসহাকের- ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’, মহাশ্বেতা দেবীর- ‘কৈবর্ত খণ্ড’, ঘনশ্যাম চৌধুরীর- ‘অবগাহন’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের- ‘গঙ্গা একটি নদীর নাম’। আমাদের এই বাংলার কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস তো কৈবর্তদের নিয়ে লিখে জীবনই পার করে দিলেন। তাঁর লেখাতে তিনি তাদের জীবনাচার, সংগ্রামময় জীবনকে সাহিত্যের উপকরণ করে তুলেছেন। এতো তাদের জীবন্ত জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
মযহারুল ইসলাম বাবলা তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছেন- ‘আমাদের ভূখণ্ডে কেন, সব দেশের আন্দোলনে, সংগ্রামে, বিপ্লবে, যুদ্ধে স্লোগান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। স্লোগানকে রণধ্বনিতুল্য বললেও ভুল হবে না। অধিকার আদায়ে, প্রতিবাদে প্রতিরোধে স্লোগানের অনিবার্যতা অস্বীকার করা যাবে না। স্লোগানই স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন-সংগ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। পারে আন্দোলনকারীদের উজ্জীবিত করতেও। স্লোগানের ভূমিকা ও তাৎপর্যের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে। রাজনৈতিক মতভেদে পাল্টাপাল্টি স্লোগানের সংস্কৃতিও রয়েছে। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয়তাবাদীদের পাশাপাশি বামপন্থিরাও ছিল। জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে বিরোধ না-থাকলেও দ্বিমত ছিল। জাতীয়তাবাদীরা কেবল জাতীয় মুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বামপন্থিরা আরও অগ্রসর হয়ে সমাজবিপ্লব সংঘটিত করে জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। জাতীয় মুক্তিই যে শেষ কথা নয়, সেটা তো মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর থেকে এযাবৎ দৃশ্যমান বাস্তবতা রূপে আমাদের সামনে সেটা জাজ্বল্যমান।
ব্রিটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস এবং গোপন সশস্ত্র যুগান্তর, অনুশীলন সমিতি ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী ধারার স্লোগান ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কবিতার (নাকি গান) ‘বন্দে মাতরম’। রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম’ কবিতাটির সুরারোপ করলেও জাতীয় কংগ্রেসকে অনুরোধ করেছিলেন ওই গানটি যেন জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা না হয়। গানটিতে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত স্বীকার করেছিলেন। কবি জসীমউদ্দীনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বন্দে মাতরম গানটি যেভাবে আছে, তোমরা মুসলমানরা এজন্য আপত্তি করতেই পার। কারণ এখানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুণ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে।’ রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে পর্যন্ত জানিয়েছিলেন, ‘ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোন গান হওয়া উচিত, যাতে এটা হিন্দু নয়। কিন্তু মুসলমান, খ্রিস্টান, এমন কী ব্রাহ্ম শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যোগ দিতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম সম্প্রদায় ‘বন্দে মাতরম’ কেবল প্রত্যাখ্যানই করেনি, বিপরীতে অনুরূপ সাম্প্রদায়িক স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছিল। ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার’। হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তির ওই স্লোগানই অবশেষে ভারত বিভক্তি অনিবার্য করে তুলেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের নিরিখে হস্তান্তরিত ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ঘটেছিল ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে মর্মান্তিক দেশভাগ।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ওই দুই সাম্প্রদায়িক স্লোগানের বিপরীতে যে স্লোগানটি সর্বভারতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার উপযুক্ত ছিল, সেটি সম্প্রদায়গত স্লোগানের তীব্রতায় গ্রহণ করেনি, না হিন্দু, না মুসলিমরা। সেটি হচ্ছে ‘জয় হিন্দ’। স্লোগানটির স্রষ্টা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সিঙ্গাপুরে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু তার গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার সুভাষ বসুর কাছে অর্পণের সময় উপস্থিত আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ শেষে সুভাষ বসু ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটি সর্বপ্রথম দিয়েছিলেন। ওই স্লোগানটি আজাদ হিন্দ ফৌজ গ্রহণ করেছিল বটে। কিন্তু ভারতীয় জনগণের ওপরও ‘জয় হিন্দ’ সাড়া ফেলতে পারেনি বন্দে মাতরম এবং নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার স্লোগানের দাপটে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ধর্মনিরপেক্ষ ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ গ্রহণ করলে সাম্প্রদায়িকতার গিলোটিনে দেশভাগ না-ও ঘটতে পারত। স্বাধীনতার পরক্ষণে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি জোর আওয়াজ তুলেছিল, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। অতীব বাস্তবানুগ হলেও তীব্র সাম্প্রদায়িক আবহ এবং তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ডামাডোলে কমিউনিস্ট পার্টির সেই স্লোগান গ্রহণের অবস্থা আর তখন ছিল না। লেখক আমাদের কাঙ্কিত স্বাধীনতা নিয়েও হতাশাগ্রস্থ হয়ে বলেছেনÑস্বাধীনতা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করেনি। আমাদের মুক্তি দেয়নি। কিছু মানুষ একচেটিয়া লুণ্ঠনের স্বাধীনতা পেয়েছিল। সমষ্টিগত মানুষ ছিল বঞ্চিত। শুধুমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতায় আমাদের সামনে দৃশ্যমান। সংবিধানে জনগণের রাষ্ট্রের মালিকানার অধিকার দিলেও প্রকৃত ক্ষমতা অধিকার শাসকশ্রেণির হাতে। তা হলে আমরা কেমন স্বাধীন হলাম। আমাদের এই রাষ্ট্রে স্বাধীনতার স্বাদ ভিন্ন। রাষ্ট্রের শাসক পরিবর্তন হয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।
সমাজের বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন মযহারুল ইসলামÑ যেখানে তিনি সমাজ ভেঙ্গে যাওয়া এবং বিচ্ছিন্ন মানুষদের যে হাহাকার এবং পরিবার ভাঙ্গণের বেদনাময়তা নিয়ে কথা বলেছেন। সমাজে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিস্তার ঘটেছে বৈষম্যের ও বিচ্ছিন্নতার। একান্নবর্তী পরিবারে ভাই-বোনেরা পরস্পর যেভাবে আন্তরিকতায় বেড়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনে সেই ভালোবাসায় ভাটির টান পড়ে পরিবারের সদস্যদের ভেতর অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। বৈষম্য সব কালেই ছিল, তবে এত নগ্নভাবে কখনও ছিল না। বৈষম্য এখন মোটা দাগে দৃশ্যমান। সমাজের বিচ্ছিন্নতাকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজে সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলেই সমাজ এবং রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে আর এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই বিচ্ছিন্নতার অবসান হয়ে পরস্পরের মধ্যে তৈরি হবে বন্ধন। যে বন্ধন এক সময় আমাদের পিতা-চাচাদের মধ্যে দেখেছি কিংবা একজন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেখেছি। একেই বুঝি বলে সম্প্রীতির বন্ধন। কিন্তু এই বন্ধুন দিনকে দিন পুঁজিবাদী চিন্তা চেতনা বা পুঁজিবাদীর আগ্রাশন আমাদের মধ্য থেকে সব কেড়ে নিয়ে আমাদের দিনকে দিন বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। এই দিক থেকে পুঁজিবাদীরা সফল। আমরা এখন আমাদের চিন্তা-চেতনাকেও পুঁজির নিক্তিতে ওজন করেনি। এই পুঁজিবাদী সিস্টেমে আজ আমরা বন্দী; জীবন ঝালাপালা। পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে আমরা এক সময় হাসাহাসি করলেও একখন তা আমাদের অন্তরেই বাস করে। দিন দিন আমরা কেমন যেন বদলে যাচ্ছি, সংকুচিত করে তুলছি নিজেদেরকে। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে যে আজ আমাদের সবকিছুতেই অবক্ষয় সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এই অবক্ষয়রোধ করতে হবে। তা না হলে যা হবার হয়ে যাবে বা হচ্ছে যা আমাদের সম্মুখে দৃশ্যমান হচ্ছে।
মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তিনি কোন আপস করেননি। তিনি মানুষকে বিজ্ঞানমস্কতার বিচারে বিশ্লেষণ করতে চান। কোন কুসংস্কার এবং অন্ধতা দিয়ে নিজের মধ্যে জট পাকিয়ে রাখেন না বরং তিনি উন্নত চিন্তা চেতনার মানুষ হওয়ার কারণে কোন অন্যায়, দুনীর্তি, মিথ্যা ভণ্ডামীকে মেনে নিতে পারেন না। সাম্প্রদায়িকতার ধোয়া তুলে মানুষকে দু’ভাগে বিভক্ত করে তুলেছে রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী মানুষেরা; যারা এই জনগণের নীতি-নির্ধারণের সর্বোচ্চ আসনে আসিন। তারাই কোন সমস্যার সঠিকভাবে সমাধান না করে সমস্যাগুলোকে নিজেদের স্বার্থে জিয়িয়ে রাখেন। সমাজের, ধর্মের প্রশ্নে মযহারুল ইসলাম বাবলা তাঁর একটা প্রবন্ধে বলেছেন- রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক জোরালো অবস্থান এবং ভূমিকাই ধর্মীয় সংঘাতের বিনাশ সাধনের একমাত্র উপায়। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্ত-পোক্ত অবস্থানে ব্যক্তি ও সমাজকে সঠিক পথানুসন্ধানের নির্দেশনা দিতে পারে। তাই সকল বিবেচনায় রাষ্ট্রের ধর্মনিরেপক্ষ এবং গণতান্ত্রিক অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।’ এই প্রাবন্ধিক সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বিশ্বরাজনীতি কিংবা তাঁর বেড়ে ওঠা, নিজের তীলে তীলে বেড়ে ওঠা জীবনের গল্প, সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মধ্যকার সম্পর্কে টানা-পোড়েন বা মানুষের জীবনের নীতি-নৈতিকতার স্থলনের বহুবিধ বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন। প্রশ্ন করেন- সমাধানের চেষ্টা করেন; কোন পথে জনগণের মুক্তি মিলবে সেই পথও মযহারুল ইসলাম বাবলা তাঁর প্রবন্ধে বাতলে দেন। বাবলা একজন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ। তিনি সমাজে সাম্যতা আর সুষ্ঠু বণ্টননীতিতে বিশ্বাসী। তাঁর দৃঢ়তায় তাকে এই ন্যায্যতা কিংবা জনগণের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তাকে বারে বারে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে ভিতর থেকে তাগাদা দেয়। এই তাগাদা যেন সমাজ রাষ্ট্র কাঠামো ও জনগণের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এই কাজটাই প্রাবন্ধিক মযহারুল ইসলাম বাবলা করে থাকেন। এতেই তাঁর প্রশান্তি-একদিন পৃথিবী শান্ত হবে, ঝড় থেমে যাবে। সৃষ্টি হবে সাম্য আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই প্রত্যাশায় বুক বাঁধেন লেখক মযহারুল ইসলামের সাথে গরিব-দুঃখী ও অবহেলিত জনগণ।
লেখক : কবি ও গবেষক