সিন্ডিকেটে চলে পাথর-বালু-সিলিকা-লুটপাট

: ইমামুল ইসলাম
প্রকাশ: ২ দিন আগে

দেশের বালু, পাথর, সিলিকা সম্পদ লুটপাটে একশ্রেণির সিন্ডিকেট সবসময় সরব থাকে। স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিংবা তাদের অগোচরে এসব জাতীয় সম্পদ লুটপাট করছে এ সিন্ডিকেট। এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নদীভাঙনে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার মধ্যে চিল সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর লুট। ফের এ এলাকায় নতুন কৌশলে সাদাপাথর লুটপাট শুরু হয়েছে।

এছাড়াও সুনামগঞ্জের ধোপাজান নদী ও তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদী এবং বরিশালের বানারীপাড়ায় সন্ধ্যা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে দেদারছে। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কাজ চলছেই, কোনোভাবেই পাথর, সিলিকা ও বালু লুটপাটে জড়িতদের দমনই করা যাচ্ছে না। নতুন নতুন কৌশলে তারা লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সেন্টমার্টিনসহ দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জোরালো ভূমিকা নিয়েছেন। তবে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে পাথর লুটের দায় নিতে নারাজ তিনি।

নবকৌশলে চলছে পাথর লুটপাট :

প্রশাসন জিরো টলারেন্সে থাকায় গত দুইমাস সাদাপাথর পরিচিতি পাওয়া সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারি ও তার আশপাশের পাথর লুট বন্ধ ছিল। সম্প্রতি সেখানে আবার শুরু হয়েছে পাথর লুট। তবে তা চলছে গোপনে ও কৌশলে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমমে প্রকাশিত সূত্রে জানা যায়- কোম্পানীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শাহ আরেফিন টিলা ও তার আশপাশে এবার নতুন করে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করে মজুদ করা হচ্ছে। তারপর সুযোগ বুঝে ট্রাক ও ট্রলিতে ঝটিকা কৌশলে তা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। প্রশাসনের অভিযানের মধ্যেই এবার এই লুটপাট চলছে। প্রশাসনের নজরদারি ও অভিযান কমে যাওয়ার সুযোগে কিছুদিন ধরে এভাবে চলছে পাথর লুট। আগে বোমা মেশিন ও লিস্টার মেশিন লাগিয়ে পাথর তোলা হতো। এখন প্রশাসনের ভয়ে সনাতন পদ্ধতিতে চলছে পাথর উত্তোলন। শাবল, বেলচা ইত্যাদির সাহায্যে গর্ত করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত এসব পাথর ছোট ট্রলি ও বড় ট্রাক্টর দিয়ে জালিয়ারপাড়, নারায়ণপুর, শাহ আরেফিন বাজার, চিকাডহর এলাকা দিয়ে কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার ক্রাশার মিলে বিক্রি করা হয়। টিলার তিনটি প্রবেশমুখে পুলিশের চেকপোস্ট থাকলেও সেগুলো এড়িয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পাথর লুট করা হচ্ছে।

সাবাড় হচ্ছে শাহ আরেফিন টিলা :

সাদাপাথর লুটের পর সাবাড় হয়ে গেছে শাহ আরেফিন টিলাও। টিলার লুটপাটের দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক সরওয়ার আলম।

গত সোমবার সরেজমিন পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক বলেন, যারা শাহ আরেফিন টিলায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, সে যত বড় ক্ষমতাধর লোকই হোক। দ্রুত তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন তিনি।

সিন্ডিকেটে চলে পাথর-বালু-সিলিকা-লুটপাট

পুরো এলাকা ঘুরে দেখে জেলা প্রশাসক জানান, এ ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে যারা আছেন তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও এর দায় বহন করতে হবে। যারাই এ অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সাময়িক বন্ধ ধোপাজান নদীর সিলিকা বালু তোলা:

সুনামগঞ্জে ধোপাজান নদী থেকে রাতের অন্ধকারে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু তুলে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে নদীতীরবর্তী জমির মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গত ৬ নভেম্বর আলফাত উদ্দিন চত্বরে বালু উত্তোলন বন্ধে মানববন্ধন করে স্থানীয়রা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়- লিমপিড ইঞ্জিনিয়ারিংকে মাত্র ৬৬ লাখ টাকায় বিধিবহির্ভূতভাবে হাজার কোটি টাকার বালুমহালের বালু উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়।

এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এই চুক্তি বাতিল করে বালু লুটের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

সিন্ডিকেটে চলে পাথর-বালু-সিলিকা-লুটপাট

শত শত অবৈধ ড্রেজার দিয়ে সুনামগঞ্জের সিলিকা বালুর নদী ধোপাজান-চলতির বালু রাতের অন্ধকারে লুট করছে। এতে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হুমকিতে পড়েছে। মাত্র ৬৬ লাখ টাকায় হাজার কোটি টাকার সিলিকা বালুর নদী খনন করে সিলেট-ঢাকা সড়কে মাটি ফেলার অনুমতি দিয়েছে বলে জানা যায়।

যদিও ধোপাজান নদী বালুমহালে সাময়িকভাবে বালু তোলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। রোববার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া।

সভার পুরো অংশজুড়েই শহরতলির পাশের ইজারা না হওয়া ধোপাজান নদীর পার কেটে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বালু লুটপাট নিয়ে আলোচনা হয়। এটি কেন শুরু থেকে বন্ধ করা হলো না, জেলা প্রশাসকের কাছে অনেক সদস্য এই ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়।

যাদুকাটা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন :

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যাদুকাটা নদীতে সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় দুটি বালুমহাল আছে। মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর চলতি মাসে আবারও বালু উত্তোলন শুরু হয়।

যাদুকাটা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন :

ছবি : ১৭ নভেম্বর ইজারাবহির্ভূত স্থান থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ১০টি নৌকা এবং একটি সেইভ মেশিন জব্দ করে বিজিবি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রে জানা যায়- লাউড়েরগড় সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় ইজারার বাইরে গিয়ে একটি পক্ষ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে। ৬ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ওই এলাকায় বালু লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইজারাদার তিনটি মামলাও করেছে।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নদীর পাড় কেটে বালু তোলার কারণে আশপাশের গ্রাম ও স্থাপনাগুলো ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর যাদুকাটা নদীর দুটি বালুমহাল প্রায় ১০৭ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। তবে মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় ইজারাদারদের বালুমহাল বুঝিয়ে দিতে দেরি হয়। চলতি মাসে প্রশাসন মহাল হস্তান্তরের পর সেখানে আবার বালু তোলা শুরু হয়।

সন্ধ্যা নদীর বালু উত্তোলন চলছে দেদারছে :

বরিশালের বানারীপাড়ায় সন্ধ্যা নদী থেকে বালু উত্তোলন চলছে দেদারছে। ৫ আগস্টের আগে যারা বালু উত্তোলন করত, তারা পালিয়ে গেলেও নতুন করে নিয়ন্ত্রণ নেয় স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা।

প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সাময়িক বন্ধ

অতিশয় ভাঙনকবলিত নদীর বালু তোলা থেকে আদায়কৃত টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিএনপি নেতার একটি তালিকা কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

জানা যায়- এ ছোট নদীর থেকে তিনটি পয়েন্ট থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এসব বালুখেকোরা ইজারা নিয়ে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বালু তুলছে। ভাঙনকবলিত নদী থেকে কীভাবে বালু তোলার ইজারা দেওয়া হয়- তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।

আইন কী বলছে :

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এ উল্লেখ আছে- বালু ও মাটি উত্তোলন বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোনো নদীর তীর ভাঙনের শিকার হয় কিংবা নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মৎস্য, জলজ ও স্থলজ প্রাণী, ফসলি জমি বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হয় বা হওয়ার আশঙ্কা থাকে এমন নদী থেকে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং আইনত অপরাধ।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে পাথর লুটের দায় নিতে নারাজ পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ১৭ আগস্ট পাথর লুটের বিষয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, পাথর কতটুকু তুললো, লুট হলো, নিয়ে গেলো- এটি আমার মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা নয়। যেহেতু আমি একজন পরিবেশকর্মী এবং সরকারে আছি…আমি দায়িত্ব নেবো, কিন্তু পাথর লুট হয়ে যাওয়ার দায়টা আমাকে দিয়েন না। এ সময় স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

  • পাথর
  • বালু
  • লুটপাট
  • সিন্ডিকেট
  • সিলিকা
  • #