মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ৩১ মার্চ সকালে ইপিআর (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট)-এর কয়েকজন বাঙালি যুবক আশ্রয় নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের হালিশহর নাথপাড়া আর আবদুপাড়ায়। তাদের আশ্রয় দেওয়ায় বিহারীরা সেদিন চোখের পলকে নাথপাড়া-আবদুপাড়াকে নরকে পরিণত করেছিল তারা।
খুকুর মা নিরবালা দেবীর কোল থেকে সন্তান কেড়ে নিয়ে দুই টুকরো করেছিল। তারপর মায়ের শরীরে সেই রক্ত ঢেলে পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠেছিল জল্লাদরা।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী খুকুর সম্ভ্রমহানির পর মৃত ভেবে আগুনে ফেলে দিয়েছিল। চোখের সামনে নিজের বাবা, বড় ভাই, দুগ্ধপোষ্য ছোট ভাইসহ ৫১ জনকে হত্যার দৃশ্য দেখার সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ধুকে ধুকে চলছেন বীরাঙ্গণা খুকু। মিলেনি কোনো স্বীকৃতি।
আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সকালবেলা দরজা ধাক্কানোর শব্দ। এপাশ থেকে জিজ্ঞেস করা হলো কে? ওপাশ থেকে উত্তর এলো- ‘আমরা ইপিআর সদস্য। আমাদের ক্যাম্প আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের আশ্রয় দিন।’ অর্ধশতাধিক মুক্তিকামী ইপিআর সদস্যকে আশ্রয় দিলেন আমার বাপ-চাচারা। আশ্রয় নেওয়া ইপিআর সদস্যদের খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা করা হলো। আমাদের ভাই-বাবারা তাঁদের আশ্বস্ত করলেন আমরা একসঙ্গে শত্রুর মোকাবেলা করব। সকাল ১০টার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি। আমরা পুকুরপাড়ের মন্দিরে আশ্রয় নিলাম। এরই মধ্যে দুপুর ১টার দিকে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিয়ে একদল লোক এসে দরজায় ধাক্কা দিল। আমরা ভেবেছিলাম তারা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ইপিআর সদস্য। কিন্তু তারা জয়বাংলা স্লোগান দিয়েছিল আমাদের প্রতারিত করতে। পরে বুঝলাম এরা শত্রুপক্ষ।
বাড়ির ভেতর ঢুকে তারা চালাল হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় তাণ্ডব। আমার বাবা-ভাইদের লাশ দেখে আমি জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি আমার চারপাশে লাশের স্তূপ। বামপাশে আগুন জ্বলছে। এক সময় বুঝলাম আগুনে আমার শরীরের একাংশ ঝলসে গেছে। ঝলসানো শরীরে একটু প্রশান্তির আশায় আমি লাফ দিলাম সামনের পুকুরে। পুকুর থেকে উঠে পাশের আবদুপাড়ায় গেলাম। কেউ আমারে চিনতেছিল না। পরিচয় দেওয়ার পর ঘরে নিয়ে খাবার দিল, চিকিৎসা করাল।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া খুকু সেদিন শুধু আগুনে দগ্ধ হননি, হারিয়েছিলেন সম্ভ্রম। সেই ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন খুকু রাণী। এই সমাজ তাকে স্বাভাবিক জীবনের সুযোগ দেয়নি, হয়নি ঘর-সংসার। চোখের সামনে নিজের বাবা, বড় ভাই, ছোট ভাই, আপন চাচাসহ অর্ধশতাধিক স্বজনের নির্মম মৃত্যু নিজের চোখে দেখা, নিজের সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস অনেকবার বলেছেন অনেককে। সবাই শুনেছেন, গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তাদের স্বীকৃতির জন্য চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে মেলেনি স্বীকৃতি। খুকু রানী এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায়। অসুস্থ শরীরে এখন চাইছেন শান্তির মৃত্যু।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, নাথপাড়ার গণহত্যা অন্য গণহত্যার নির্মমতার বিচারে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আমরা অনেক চেষ্টা করেও নাথপাড়া, আবদুপাড়াবাসীর জন্য কিছুই করতে পারিনি। শেষে একটি শহীদ বেদী তৈরি করে দিয়েছি। সেটিও এখন অযত্ন অবহেলায় রয়েছে।
ডা. মাহফুজুর আরো বলেন, যাদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের এই যশ-খ্যাতি ও অর্জন, তাঁদের আত্মার অভিশাপে যদি এ অর্জন কোনোদিন মুখ থুবড়ে পড়ে, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সূত্র : কালের কণ্ঠ