চলতি বছরের অন্যতম গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ছিল মব সন্ত্রাস করে গণপিটুনিতে হত্যাকাণ্ড। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মব সন্ত্রাসে কমপক্ষে ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন। এর আগের বছর মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হন অন্তত ১২৮ জন।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) সকালে ২০২৫ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য জানানো হয়। দেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত মানবাধিকার সম্পর্কিত সংবাদ এবং আসকের পর্যবেক্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
আসকের তথ্যানুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়কালে কমপক্ষে ২৯৩ জন নাগরিক মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। মব সন্ত্রাস করে নারী, পুরুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক অনেক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা, বাউল সম্প্রদায়ের মানুষসহ অনেক মানুষকে হেনস্তা করা হয়েছে, মারধর, জুতার মালা পড়ানোর ঘটনা ঘটেছে।
আসকের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ২০২৫ সালে ঢাকায় সর্বাধিক ২৭, গাজীপুরে ১৭, নারায়ণগঞ্জে ১১, চট্টগ্রামে ৯, কুমিল্লায় ৮, ময়মনসিংহে ৬, বরিশালে ৬, নোয়াখালীতে ৬, গাইবান্ধা জেলায় ৬, শরীয়তপুরে ৬, লক্ষীপুরে ৫, সিরাজগঞ্জে ৫, টাঙ্গাইলে ৫, নরসিংদীতে ৪, যশোরে ৪ জনসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মব সন্ত্রাসে কমপক্ষে ১৯৭ জন ব্যক্তি নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
এ ছাড়া মাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৫ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে গণপিটুনির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য মাসের থেকে বেশি ঘটেছে। এই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, যদিও অধিকাংশ ভুক্তভোগী ছিলেন দল-মত নিরপেক্ষ সাধারণ নাগরিক। সংগৃহীত তথ্যে আরও দেখা যায়, গণপিটুনির শিকারদের মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত সাত জন সদস্য, নারী তিন জন এবং একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন, যা এই সহিংসতার সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর অসম প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে এবং একে একটি গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ হিসেবে চিহ্নিত করে।
এ বছর সংগঠিত মব সহিংসতাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক ভিন্নমত, ধর্মীয় উগ্রবাদ, গুজব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মব সহিংসতাগুলো সংঘটিত হয়। তওহিদি জনতার নাম ধারণ করে মব সন্ত্রাস করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শিল্প-সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র ভাঙচুর, নারী ও ভিন্ন মতাবলম্বিদের হেনস্তা করা হয়েছে।
আসকের তথ্য সংগ্রহে জানা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ১৯ বছর বয়সী শ্রমিক হৃদয়কে চুরির অভিযোগ তুলে মব সৃষ্টি করে রশি দিয়ে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে। এ বছরের ২২ জুন লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী সেলুনকর্মী পিতা ও তার ছেলে পরেশ চন্দ্র শীল ও বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে মারধর করে। অন্যদিকে, ২২ জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদার ওপর মব সৃষ্টি করে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে ও জুতার মালা পরিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
আসকের তথ্য সংগ্রহে জানা গেছে, ৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ভ্যান চোর সন্দেহে পিটিয়ে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা রুপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার প্রদীপ দাস (৩৫)। রূপলাল দাস জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং প্রদীপ দাস ভ্যান চালাতেন। রুপলাল দাসের মেয়ের বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রূপলাল দাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ দাস। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছলে ভ্যান চোর সন্দেহে তাদের দুজনকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। উল্লেখ্য, ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও পুলিশ কোনও ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে ঘটনাস্থলে অধিক লোকের জড়ো হওয়া দেখে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করার অভিযোগ রয়েছে।
ফটিকছড়িতে চোর সন্দেহে গণপিটুনি; এক কিশোর নিহত, দুই জন গুরুতর আহতের ঘটনায় আসকের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বছরের ২২ আগস্ট ভোরে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের চেঙ্গখাল ব্রিজ এলাকায় চোর সন্দেহে সংঘটিত এক মব হামলায় মো. রেহান উদ্দিন প্রকাশ মাহিন (১৫) নামে এক কিশোর নিহত হয় এবং আরও দুই কিশোর গুরুতর আহত হয়।
নিহত মাহিন এবং আহত মানিক ও রাহাত এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে স্থানীয় একটি দল তাদের ধাওয়া করে ধরে এনে রশি দিয়ে ব্রিজের সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে মারধর করে।
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী, হামলার নেতৃত্বে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছিলেন এবং ঘটনাটি নিছক চোর সন্দেহের গণপিটুনি নয়; বরং পূর্ব বিরোধ ও স্থানীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার সময় ভুক্তভোগীদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করা হয় এবং পরিবারের সদস্যদের বাধা দিতে গেলে তাদেরও মারধর করা হয়।