ওহাবি বনাম মুসলিম কাফের

: রেজাউল করিম
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব (১৭০৩-১৭৯২) ছিলেন আরব দেশের নজদ প্রদেশের উয়ায়না গ্রামের একজন ধর্মীয় আলেম। তিনি ছিলেন খুবই গোড়া, রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থি ধর্মনেতা। তাঁর মতে, ইসলাম ধর্মে নানা অনাচার প্রবেশ করেছে, শিরক-বিদাতে ভরে গেছে। মুসলমানরা ইসলামের মূল আদর্শ থেকে সরে গেছে। মুসলমানরা মুশরিক হয়ে গেছে। মুশরিক মানে পৌত্তলিক। পৌত্তলিক মানে কাফের। কাফেরদের কতল করতে ইবনে ওহাব জিহাদের ডাক দেন। আর ইবনে ওহাব প্রণীত ও প্রচারিত জিহাদি মতবাদ বা আন্দোলনই হচ্ছে ওহাবি মতবাদ বা ওহাবি আন্দোলন। ইবনে ওহাবের অনুসারী বা ইবনে ওহাবের মতবাদে বিশ্বাসীদের বলা হয় ওহাবি। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে ওহাবিরা ইসলামের পুরুজ্জীবন ঘটানোর জন্য জিহাদি আন্দোলন করতে থাকেন। ওহাবিরা অবশ্য নিজেদেরকে ওহাবি বলে পরিচয় দেন না। তারা নিজেদেরকে মনে করেন সালাফি। ওহাবি হচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষ মুশরিকদের দেওয়া নাম। প্রতিপক্ষরা নিন্দার্থে ওহাবি শব্দ ব্যবহার করত। তবে ওহাবিরা যে সকল কাফেরদের কতল করেন, তারা ছিলেন মুসলিম কাফের।
ওহাবিদের প্রতিপক্ষ ছিলেন সুফি, মাজারকেন্দ্রিক পীর, আউলিয়া, দরবেশ, অটোমানপন্থি, উদারপন্থি, সংস্কৃতিপ্রেমী, পেশাদার মহিলা, শিয়া সম্প্রদায়। ওহাবিরা এদেরকে কাফের বলত। ওহাবি মতে, এরা শিরক, বিদাত ও কুফরিতে নিমজ্জিত। ইবনে ওহাব প্রণীত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ গ্রন্থে শিরক, বিদাত ও কুফরনামি কর্মের বর্ণনা রয়েছে। যেমন- কবর জিয়ারত করা, কবরবাসীর জন্য দোয়া করা, কবরবাসীর কাছে কিছু চাওয়া, রোগমুক্তি ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার লাভের আশায় তাবিজ ঝুলানো, গাছ ও পাথর থেকে বরকত গ্রহণ করা, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য পশু যবেহ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য মানত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে আশ্রয় চাওয়া, কবর পূজা করা, আল্লাহ ও বান্দার মাঝে উসিলা নির্ধারণ করা এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য অলি-আউলিয়ার কাছে শাফায়াত চাওয়া ইত্যাদি। তারপর রয়েছে- ধূমপানের জন্য বেত্রাঘাত, দাড়ি না রাখা ও ঠিকমত যাকাত না দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ, মহিলারা শুধু পর্দা করলেই চলবে না, পুরুষ অভিভাবক ব্যতীত ঘরের বাইরে বেরুতে পারবে না, যাবতীয় নাচ-গান, খেলাধুলা, ছবি অঙ্কন হারাম বলে ফতোয়া জারি। এমনকি ফুটবল খেলাকেও হারাম বলে ঘোষণা দেয়।
গোলাম আহমদ মোর্তজা রচিত ‘চেপে রাখা ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে- শুধু কলেমা পড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে কোনো হালাল পশু জবেহ করলেই তা হালাল খাদ্য হবে না, যদি না তার চরিত্র মোটামুটি কলঙ্কমুক্ত না হয়। কুরআন-হাদিসের সরল অর্থ বেঁকিয়ে ব্যাখ্যা করা নিষিদ্ধ, জামাতে নামাজ পড়া জরুরি, কবরের উপর সৌধ নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, ইট-পাথর দিয়ে কবর বাঁধাই করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেই ওহাবিরা ক্ষান্ত হননি। তারা মক্কা-মদিনার অনেক নামজাদা মনীষীর রওজা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। এমনকি তারা হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজাও ভেঙে দেন। (William Hunter, The Indian Musalmans, p. 51). তারা হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ঐশী গুণাবলীতে অবিশ্বাস করে, তাঁর নামে নামাজ আদায় বারণ করে এবং বিগত ওলিদের উদ্দেশে প্রার্থনা করতেও নিষেধ করে। তারা চরম একশ্বরবাদী। তাদের মতবাদের মূলমন্ত্র হল আল্লাহর একত্ব বাস্তবায়ন করা এবং আত্মোৎসর্গ করা। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি বা মাধ্যমের স্থান নেই। এজন্য সুফি ও শিয়াদের সাথে ওহাবিদের বিরোধ। সুফি ও শিয়াদের মতে, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে মাধ্যমের দরকার হয়। আর এ মাধ্যম হচ্ছে গুরু বা পীর বা ইমাম।
মুহাম্মদ ইবনে ওহাব তার ধর্মীয় মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একজন শাসকের প্রয়োজন অনুভব করেন। সে লক্ষ্যে তিনি নজদের প্রশাসনিক কেন্দ্র দিরিয়ার আমির শেখ মুহাম্মদ ইবনে আল সউদ (১৬৮৫-১৭৬৫) এর সাথে বন্ধুত্ব করেন। ইবনে সউদ ইবনে ওহাবের অনুসারী হন। ইবনে ওহাব ৬০ বছর বয়সি বৃদ্ধ ইবনে সউদের কাছে নিজ কন্যাকে বিয়ে দেন। ১৭৪৪ সালে তাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। তারা সম্মিলিতভাবে আরবে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে এবং তার ভিত্তি কট্টর শরিয়া আইন। চুক্তি অনুসারে মুহাম্মদ ইবনে আল সউদ হবেন ওহাবি রাজ্যের রাষ্ট্রনেতা এবং মুহাম্মদ ইবনে ওহাব হবেন ধর্মনেতা। সে চুক্তি মোতাবেক এখনো সৌদি আরবের ধর্মমন্ত্রী হন ইবনে ওহাব বংশধরদের মধ্য থেকে। যাহোক, রাষ্ট্রনেতা-ধর্মনেতা জামাই-শ্বশুর ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবেশি উপজাতি ও বেদুইনদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ওহাবিরা ইখওয়ান (ধর্মযোদ্ধা) নামে সেনাদল গড়ে তুলে। তারা ছিল ধর্মযুদ্ধে উদ্দীপ্ত এবং জিহাদের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকত।
আরব বিশ্বে তখন ছিল তুর্কি উসমানীয় (অটোমান) শাসন। তুর্কিরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে গোড়া ছিল না। তারা ছিল সুফি ভাবধারায় প্রভাবিত। সুফি, শিয়া, অটোমানরা, উদারপন্থিরাও ওহাবিদের পাল্টা কাফের বলা শুরু করল। আর ওহাবিদের দৃষ্টিতে তাদের মতবাদের বাইরে সবাই কাফের। ওহাবি ধর্মীয় মতবাদ শুধু আরবে নয়, আরবের বাইরে ইরাক, সিরিয়া, মরক্কো, ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ওহাবিরা আরবের বিভিন্ন বেদুইন উপজাতিদের আক্রমণ করে তাদের সম্পদ গণিমতের মাল হিসেবে অর্জন করতে থাকে। বিজিত অঞ্চলে ওহাবিরা ধর্মকর (যাকাত), জমির খাজনা, বাণিজ্য কর আদায় করতে থাকে। বিরুদ্ধবাদী শহর ও প্রদেশগুলো ছিল ওহাবিদের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। কোন শহর বা প্রদেশ ওহাবি মতবাদ গ্রহণ না করলে তারা বিদ্রোহী বলে গণ্য হতো। বিদ্রোহের প্রথম শাস্তিস্বরূপ তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা হত। লুণ্ঠিত সম্পদের পাঁচ ভাগের চার ভাগের মালিক হত যোদ্ধা এবং অবশিষ্ট এক ভাগ যেত সাধারণ কোষাগারে। আর দ্বিতীয়বার কেউ বিদ্রোহ করলে বা ওহাবি মতবাদ ত্যাগ করলে তাদের হত্যা করা হত এবং তাদের স্থায়ী সম্পত্তি জমিজমা, বাড়িঘর, শহর ওহাবি নেতাদের নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হত। বছরে অন্তত তিনবার অভিযান চালিয়ে দলের সম্পদ ও রাজস্ব আদায় করা হত।
১৭৬৫ সালে মুহাম্মদ ইবন সউদ মারা গেলে তার পুত্র আবদুল আজিজ ইবন মুহাম্মদ তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৭৯১ সালে ওহাবিরা মক্কার প্রধান শেখের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাফল্য পায়। ১৭৯২ সালে মুহাম্মদ ইবনে ওহাব ইন্তকাল করলেও ওহাবিদের অভিযান বন্ধ থাকেনি। ১৭৯৭ সালে ওহাবিরা বাগদাদের পাশাকে পরাজিত করে ও তার বহু সৈন্যকে হত্যা করে। এশিয়াস্থ অটোমান তুর্কিদের বহু উর্বর প্রদেশ দখল করে নেয়। ১৮০১ সালে তারা লক্ষাধিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কা শরিফে অভিয়ান চালায় এবং ১৮০৩ সালে তারা তা দখল করে নেয়। ১৮০৪ সালে তারা মদিনা শহর হস্তগত করে। মক্কা ও মদিনাতে যে সকল মুসলিম ওহাবিদের মতবাদ গ্রহণ অস্বীকৃতি জানান তাদেরকে হত্যা করা হয়। মুসলিম সাধু পুরুষদের মাজার-খানকাহ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মক্কা ও মদিনার পবিত্র মসজিদও রেহাই পায়নি। এগারোশত বছর ধরে মুসলিম রাজা-বাদশাহ, সুলতান-খলিফাদের পাঠানো অজস্র মূল্যবান দ্রবসামগ্রী থরে থরে ভক্তিসহকারে সংরক্ষিত ছিল পবিত্র মসজিদ ও কাবায়। সে সমস্ত সম্পদও ওহাবিরা নিয়ে নেয়। (William Hunter, The Indian Musalmans, p. 51). এদিকে আবদুল আজিজ তাঁর পুত্র সউদকে ইরাকের শিয়া অধ্যুষিত শহর কারবালা ও নাজাফ আক্রমণের নির্দেশ দেন। সউদ ১৮০২ সালের ১২ মে (মহরম মাসের ১০ তারিখ) কারবালা ও নাজাফ আক্রমণ করে হাজার হাজার শিয়াকে হত্যা করে, ইমাম হোসেন ইবন আলী (রা.) এর সমাধি ধ্বংস করে দেয়। তারা ৪০০০ উট বোঝাই করে শিয়াদের ধন-সম্পদ লুট করে নেয়। (Sayad Khatab, Understanding Islamic Fundamentalism, p. 74).
মক্কা-মদিনায় ওহাবিদের এমন নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ মুসলিমবিশ্বে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান ও ইসলাম ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসনালয় মক্কার কাবা ঘর ওহাবিদের দ্বারা লুণ্ঠিত ও কলুষিত হয়। এমনকি তারা মক্কায় হজ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। ফলে ১৮০৩ থেকে ১৮০৯ খ্রি পর্যন্ত কোনো হজকাফেলা মরুভূমি অতিক্রম করতে পারেনি। প্রতিটি মসজিদে মুসলমানদের ক্রন্দন ও আর্তনাদ তীব্র হয়ে উঠে। কোনো কোনো শিয়া মুসলিম বলে উঠল যে, দ্বাদশ ইমামের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী। গোড়া মুসলিমরা ভাবতে লাগল যে, দাজ্জাল দুনিয়ার বুকে নেমে এসেছে এবং রোজ কিয়ামত সমাগত।
এরপর ওহাবিরা সিরিয়া আক্রমণ করে, পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তুর্কি রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অধিকার করার ভয় দেখায়। তখন অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ মিশরের মুহাম্মদ আলী পাশাকে ওহাবিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। মুহাম্মদ আলী পাশা তাঁর বড় ছেলে তুসুনকে ওহাবিদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ১৮১১ সালে তুসুন পাশা ওহাবিদের বিরুদ্ধে কোনো সুবিধা লাভ করতে পারেননি। পরের বছর ১৮১২ সালে তিনি ওহাবিদের নিকট থেকে মদিনা শহর এবং ১৮১৩ সালে মক্কা পুনরুদ্ধার করেন। পাশার অভিযানে ওহাবিরা পরাজিত হলেও তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়নি। তারা নজদ উপদ্বীপ অঞ্চলে অটোমান ও মিশরীয় বাহিনীকে হয়রানি করতে থাকে। তখন (১৮১৬ খ্রি) মুহাম্মদ আলী পাশা তাঁর আরেক পুত্র ইব্রাহিম পাশাকে ওহাবিদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি দুই বছর অভিযান চালিয়ে ওহাবিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। বেশির ভাগ সৌদি পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে বন্দি করা হয়। সউদ পরিবারের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে সউদকে বন্দি করে ইস্তাম্বুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৮২৪ সালে সউদ পরিবারের সদস্য তুর্কি ইবনে সউদের নেতৃত্বে ওহাবিরা নজদ দখল করে একটি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩৮ সালে তুর্কি ইবনে সউদ আততায়ীর হাতে নিহত হলে তার পুত্র ফয়সাল ইবনে সউদ বংশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৩৮ সালে মিশরের পাশা বাহিনী নজদ দখল করে ফয়সালকে বন্দি করে কায়রো নিয়ে যান।এরই মধ্যে অটোমান তুর্কিদের সঙ্গে মুহাম্মদ আলীর পাশার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পাশা মিশরকে শক্তিশালী করতে নজদ থেকে তাঁর বাহিনী তুলে নেন। এদিকে ফয়সাল পঁপচ বছরের বন্দি জীবন কাটিয়ে কায়রো থেকে পলায়ন করে নজদে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি নজদ ও হাসার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রেণে নেন। ১৮৬৫ সালে ফয়সালের মৃত্যু হলে ক্ষমতা দখল নিয়ে তার পুত্রদের মধ্যে বিবাদ হয। সে সুযোগে হাইলের শাম্মার গোত্রের এক নেতা মুহাম্মদ ইবন রশিদ শক্তি সঞ্চয় করে নজদের অধিকাংশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৮৭১ সালে হাসা দখল করেন। ১৮৯১ সালে রশিদী বংশ রিয়াদ দখল করে নিলে আবদুর রহমান ইবনে ফয়সাল প্রথমে বাহরাইনে এবং পরে ১৮৯৫ সালে সপরিবারে কুয়েতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কুয়েতের আমীর শেখ মুহাম্মদ আস-সাবাহ তাকে আশ্রয় দেন।
১৮৯৭ সালে রশিদী বংশের শাসক মুহাম্মদ ইবনে রশিদ মারা গেলে সউদ বংশের সামনে সুযোগ তৈরি হয়। ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি রাতের অন্ধকারে আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে সউদ ৬০/৭০ জন অনুসারী নিয়ে রিয়াদে প্রবেশ করে রশিদী বংশের শাসক আজলানকে হত্যা করে রিয়াদ দখল করেন। ১৯০৫ সালে আবদুল আজিজ সমগ্র নজদ দখল করেন। ১৯০৬ সালে কাসিম এবং ১৯১৩ সালে হাসা তাঁর দখলে আসে। তিনি নজদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে গোড়া ওহাবিদের নিয়ে ইখওয়ান (ধর্মযোদ্ধা) নামে এক সুসংগঠিত সেনাবাহিনী গঠন করেন। ১৯১৫ সালের মধ্যে নজদের ২০০ বসতিতে ইখওয়ানের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লক্ষ। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকত।
১৫১৭ সাল থেকে আরব উপদ্বীপ তুর্কি অটোমান শাসনাধীনে আসে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা বহাল থাকে। আরবের বিভিন্ন বংশ তুর্কিদের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে নিজ নিজ অঞ্চল শাসন করত। হিজাজ (মক্কা ও মদিনা) ছিল শরীফ হুসেনের শাসনাধীনে, নজদ সউদ বংশের অধীনে, ইদ্রিসি মুহাম্মদের অধীনে আসির অঞ্চল, ইবনে রশীদের অধীনে হাইল রাজ্য, ইমাম ইয়াহইয়ার অধীনে ইয়েমেন শাসিত হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ছিল জার্মানির পক্ষে। ব্রিটেন ছিল জার্মানির বিপক্ষ শক্তি। ১৯১৪ সালে কুয়েতের ব্রিটিশ প্রতিনিধি Captain W.H.I. Shakespeare নজদে গিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে আবদুল আজিজের সহযোগিতা কামনা করেন। এ প্রস্তাব তিনি লুফে নেন। এদিকে ১৯১৬ সালের জুন মাসে শরিফ হুসেন তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মিত্রপক্ষে যোগ দেন এবং নিজেকে আরবের বাদশাহ ঘোষণা করেন। আবদুল আজিজ শরিফ হুসেনকে আরবের বাদশাহ মেনে নিতে অস্বীকার করেন। শুরু হয় শরিফ বংশ, রশিদী বংশ ও সউদ বংশের মধ্যে যুদ্ধ এবং তা চলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সউদ বংশ জয়ী হয়। ১৯২৬ সালের ৮ জানুয়ারি আবদুল আজিজ নিজেকে হিজাজের বাদশাহ এবং নজদ ও তার আশ্রিত রাজ্যের সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯২৭ সালের ২০ মে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আরবের স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৩২ সালে আবদুল আজিজ তাঁর পিতৃপুরুষ সউদের নামানুসারে তাঁর দখলকৃত আরব রাষ্ট্রের নাম রাখেন ‘সৌদি আরব’ (The Kingdom of Saudi Arabia).
ক্ষমতায় আরোহণ করে বাদশাহ আবদুল আজিজ তাঁর রাজ্যকে আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেন। যেমন- আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির ব্যবহার, মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, বেতারযন্ত্র, টেলিগ্রাফ, বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য দান গ্রহণ করা। কিন্তু এতে ওহাবি ইখওয়ান সদস্যরা চরমভাবে বাধা দেয়। তারা এসব জিনিসকে বিজাতীয় ও বিধর্মী হিসেবে অখ্যায়িত করে। এসব ব্যবহার করলে ঈমান-আকিদা নষ্ট হবে। এছাড়া ইখওয়ান সদস্যরা ইখওয়ান সদস্যবিহীন বেদুইন গোত্রগুলোকে আক্রমণ করে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করতে থাকে এবং তাদের বিধর্মী হিসেবে আখ্যা দিয়ে হত্যা করতে থাকে। ইখওয়ান নেতা ফয়সাল আদ-দুবিশ, সুলতান ইবনে হুমায়েদ, জায়দান ইবনে হিসলায়েন ও আরো কয়েক ইখনাওয়ন নেতৃবৃন্দ বাদশাহ আবদুল আজিজকে ব্রিটিশের দালাল মনে করে তাঁর প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে হত্যা লুণ্ঠন অব্যাহত রাখে। তাদের আক্রমণ থেকে ইরাক ও কুয়েতের গোত্রসমূহ রেহাই পায়নি। অবশেষে বাদশাহ আজিজ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ১৯২৯-৩০ সালের দিকে তাদের দমন করতে সমর্থ হন। মজার ব্যাপার যে, ইখওয়ানদের রীতি ছিল বিধর্মীদের দেখামাত্র হত্যা করা। আর সে বিধর্মী ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে ইখওয়ান নেতারা আত্মসমর্পণ করে। ব্রিটিশের পরামর্শে বাদশাহ ইবনে সউদ তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে দুর্গে বন্দি করে রাখেন। সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। তবে তাদের লুণ্ঠিত সম্পদ জব্দ করা হয়।
সৌদি আরবে জারি হল শরিয়া শাসন। অমুসলিমদের স্থায়ীভাবে বসবাস নিষিদ্ধ হল। ইসলামের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরবে ওহাবি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্যান্য মুসলিম তো দেশে রপ্তানি হতে থাকে। ওহাবি ভাবধারা সৌদি ব্যতীত ব্রিটিশ ও মার্কিনিদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। কারণ তারা ওহাবি মতবাদকে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ আজ পশ্চিমারা ওহাবিবাদকে সন্ত্রাসের আঁতুরঘর বলে অভিহিত করে। এ কথা স্বীকার করেছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি ২০১৮ সালের ২২ মার্চ ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “গত শতকের ’৭০ এর দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় পশ্চিমারাই ওয়াহাবিবাদের প্রচারে অর্থ ঢালতে সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছিল। মুসলিম দেশগুলো যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে চলে না যায়, সেজন্যই পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছিল। সেই অনুরোধে বিভিন্ন দেশে মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থ ঢেলে ওয়াহাবি মতাদর্শের বিস্তারে কাজ শুরু করে সৌদি আরব।” যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রদপ্তরে এক পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফ জানায়, পরমতসহিষ্ণু সুন্নিদের উগ্র ওয়াহাবিবাদে দীক্ষিত করতে ১৯৭০ থেকে চার দশকে ১ হাজার কোটিরও বেশি ডলার ঢালে সৌদি আরব। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ২৯ মার্চ ২০১৮)।

লেখক : সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক

  • ওহাবি
  • কাফের
  • মুসলিম
  • #