ভাঙন আতঙ্ক সন্ধ্যা নদীর তীরে

: রাহাদ সুমন, বানারীপাড়া (বরিশাল)
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

সন্ধ্যা নদীর তীরে ১০-১৫ বছর ধরে চায়ের দোকান করে সংসার চালাচ্ছিলেন হাবিবুর রহমান ফকির। তাঁর দোকানটি পড়েছে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের উত্তর নাজিরপুর দান্ডয়াটে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নদীর ঢেউয়ে ভেঙে গেছে দোকানটি। এতে বিপাকে পড়েছেন হাবিবুর। সব মিলিয়ে তাঁর প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়েছেন তিনি।

একই রাতে হাবিবুরের মতো দোকান হারিয়েছেন মারুফ ফকির। তাঁর মুদি দোকানে পণ্য ছিল প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার। মারুফ বলেন, এক রাতে দোকানঘরটি মালপত্রসহ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে সব হারিয়ে পথে বসেছেন। এক রাতের ব্যবধানে তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে পাশের আরও পাঁচ-সাতটি দোকান। যে কোনো সময় সেগুলোও নদীতে তলিয়ে যেতে পারে।

গত বৃহস্পতিবার রাতেই দান্ডয়াটলাগোয়া (ধানের হাট) ইটভাটা মেসার্স মুনা ব্রিকসের একাংশ ধসে পড়ে নদীতে। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম মনির বলেন, দুর্ঘটনাটি রাতে ঘটায় সেখান থেকে একটি ইটও সরাতে পারেননি। সব মিলিয়ে ৫-৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে তাঁর।

ওই এলাকায় সন্ধ্যা নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে উত্তর নাজিরপুর দান্ডয়াট জামে মসজিদ ও গুচ্ছগ্রাম। নদী ভাঙতে ভাঙতে মসজিদের ৫০-৬০ গজের মধ্যে চলে এসেছে বলে জানান মসজিদ কমিটির সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন ফকির। তিনি বলেন, প্রতিবছর নদী ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসছে। গত বছরও মসজিদ থেকে ১০০-১৫০ গজ দূরে ছিল নদী। বৃহস্পতিবার রাতে ভাঙনের পর নদীর সঙ্গে দূরত্ব ৫০-৬০ গজে নেমে এসেছে।

শুক্রবার বানারীপাড়ার কয়েকটি এলাকা ঘুরে ভাঙনের এসব তথ্য পাওয়া যায়। এলাকাবাসী জানায়, ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের খোদাবখসা গ্রামের বয়াতি বাডির পুরোনো জামে মসজিদ ও মসজিদলাগোয়া আয়রন ব্রিজটি নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে নদীতীরে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের। দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা নদীভাঙন রোধে টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।

উপজেলার খোদাবখসা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন বলেন, ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে বয়াতিবাড়ির বহু পুরোনো মসজিদ ও পাশের সেতুটি নদীতে তলিয়ে যাওয়ায় এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ওই এলাকার বেশ কিছু বসতবাড়ি ও রাস্তাঘাট যে কোনো সময় নদীতে চলে যাবে। নদীভাঙনের জন্য তিনি যত্রতত্র বালু তোলা বন্ধের দাবি জানান। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, ভাঙন আতঙ্কে থাকা অনেক মানুষ গাছপালা কেটে নিচ্ছেন। অনেকে ঘরবাড়িও সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সন্ধ্যা নদীর ভাঙাগড়ার খেলায় এরই মধ্যে উপজেলার সদর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণকাঠি, জম্বদ্বীপ, কাজলাহার, সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের খোদাবখসা, খেজুরবাড়ী; চাখার ইউনিয়নের চাউলাকাঠি, সোনাহার হক সাহেবেরহাট, কালিবাজার, সৈয়দকাঠি ইউনিয়নের নলশ্রী, দিদিহার, মসজিদ বাড়ি, তালাপ্রসাদ, জিরারকাঠি ও দাসেরহাট; বাইশারী ইউনিয়নের বাংলাবাজার, নাটুয়ারপাড়, উত্তরকুল, উত্তর নাজিরপুর দান্ডয়াট, শিয়ালকাঠি ও বৌসেরহাট এবং ইলুহার ইউনিয়নের ইলুহার গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বেশির ভাগ অংশ ভাঙনে ক্ষতির শিকার হয়েছে। এসব গ্রামের অনেক অংশই উপজেলার মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে নদীতে হারিয়ে গেছে। হাজারো পরিবার হারিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। সন্ধ্যা নদীতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ ও ফসলি জমি। ভিটেমাটি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে হাজারো পরিবার। অনেকেই ঠাঁই নিয়েছে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ জানায়, সন্ধ্যা নদীর ভাঙন চলছে যুগের পর যুগ। তবু ভাঙন রোধে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বছর দুয়েক আগে ভাঙন রোধে তৎকালীন সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম প্রথমবারের মতো হাজার হাজার বালুবর্তি জিও ব্যাগ নদীতে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে শেষ রক্ষা সম্ভব হয়নি। এ জন্য সন্ধ্যার বুকে যত্রতত্র বালু তোলাকে দায়ী করেন। স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা বলেন, এভাবে বালু তোলায় নদীর তলদেশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ফলে গতিপথ বদলে তীরে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। চলতি বর্ষা মৌসুমে ভাঙন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

সন্ধ্যা নদীতীরের ভাঙন সম্পর্কে অবগত আছেন বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডা. অন্তরা হালদার। তিনি বলেন, ভাঙন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

  • নদীভাঙন
  • সন্ধ্যা
  • #