প্রাচীন বাংলাভাষার উদ্ভব হয় পাল শাসনামলে (বৌদ্ধদের পাল শাসনামল আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়ে প্রায় চারশো বছর টিকে ছিল)। এই সময়ই সিদ্ধাচার্যগণ প্রাচীন বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করেন। যার নাম ‘চর্যাপদ’। বৌদ্ধ পাল শাসনামলের পর কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী বৌদ্ধ বিদ্বেষী সেন শাসনামল শুরু হয়ে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত টিকে ছিল। সেনদের শাসনামলে বাংলা ভাষার বিকাশ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। সংস্কৃত ভাষার দৌরাত্ম্য শুরু হয়। সেন শাসনামলের অবসান হয়ে মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামল না আসলে বাংলা ভাষার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেত। বাংলা ভাষাকে আর খুঁজেই পাওয়া যেত না। তবে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাকে দিল্লির উপর্যুপুরি আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ্-এর ক্ষমতা দখল হতে প্রকৃত অর্থে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি যুগ শুরু হয় এবং তা ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির বাদশাহ্ আকবর কর্তৃক বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানিকে হত্যা করে বাংলা দখল করা পর্যন্ত বহাল থাকে।
ইলিয়াস শাহ্-এর সময় হতে বাংলায় নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ্ (১৩৯৩-১৪০৯ খ্রি.), রুকনউদ্দিন বরবক শাহ্ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.), আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) প্রমুখ সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হতে থাকে। এই সময়ের মধ্যে শাহ্ মুহাম্মদ সগীর, বৃহস্পতি মিশ্র, মালাধার বসু (গুণরাজ খান), চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস, যশোরাজ খান, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস, জ্ঞানদাস প্রমুখদের মতো কালজয়ী বিদ্বান ও পণ্ডিতদের আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। চৈতন্যদেবের প্রভাব সাহিত্য সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রাখে। আর সতের শতকে সৈয়দ সুলতান, দৌলত কাজী ও আলাওলের মতো শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদেরও আমরা পাই। মুঘল শাসনামলে অবশ্য বাংলাভাষা খুব বেশি এগুতে পারেনি।
পূর্বে সাহিত্য চর্চা পদ্য বা কবিতাতে করা হতো। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খোলা হলে এ বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম কেরির পৃষ্ঠপোষকতায় তার সহযোগী উড়িয়া ভাষাভাষী সংস্কৃত পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার সংস্কৃত শব্দপ্রধান বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূচনা করেন। সে ধারাতেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের মাধ্যমে গদ্যধারা প্রতিষ্ঠা পায়। আগেকার গীতপ্রধান, সুরেলা, ভক্তি-রসে উচ্ছ্বসিত ভাষা রামমোহনের হাতে হয়ে উঠল বাস্তবমুখী, কাট-কাট ক্ষুরেলামুখী। প্রকৃত অর্থে রামমোহনের হাতেই গদ্য সাহিত্যের প্রচলন হয়।
রামমোহনের হাতে গদ্যের প্রচলন হলেও তাকে সুশ্রাব্য, সরস, সতেজ ও ছন্দময় করে পরিমার্জিত রূপটা প্রদান করেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তা ছাড়া রামমোহন কিছুটা ভাবলেও বিদ্যাসাগরই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি সবচেয়ে বেশি ভাষার সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন। তিনি বাংলা ভাষার আমূল সংস্কার করে যুগের উপযোগী করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর ভাষাটাকে দাঁড় করেন। স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ নির্দিষ্ট করে বর্ণের সংযোজন বিয়োজন করে বর্ণমালা নতুন করে সাজিয়ে ভাষাটাকে একটা দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেন। তিনি বিভিন্ন যতি চিহ্নের প্রচলন করে ভাষাটাকে যুগোপযোগী করেন। তবে এ পর্যন্ত যা কিছু করা হয়েছে তার সবই কিন্তু সংস্কৃতের আদলেই করা হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের প্রচলিত সংস্কৃত ভাবধারা হতে বের হওয়া সম্ভব হয়নি।
আমরা সবাই জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বাংলা ভাষাটাকে বিশ্বমাত্রায় উন্নীত করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে বাঙালির একটা গৌরবের বিষয়। তবে আমার কাছে অন্য যে বিষয়টা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় সেটা হচ্ছে, ভাষার সমস্যা সমাধানে তার অবদান। আমরা বহু কবি-সাহিত্যিক পেয়েছি। কিন্তু ভাষার সমস্যা নিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো করে আর কেউ ভেবেছেন বলে আমার মনে হয় না। আজকে যে ভাষায় আমরা লিখছি, পড়ছি, কথা বলছি, সাহিত্য চর্চা করছি তার মূলে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাঙালি ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলা ভাষা সমস্যার বিষয়টি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
প্রথমত রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে সংস্কৃতের নিগড় হতে অনেকটাই উদ্ধার করেছেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে যখন গদ্য চর্চা শুরু হয়, তখন বাংলাভাষাকে সংস্কৃতের আদলে ঢেলে সাজানো হয়েছিল। এটা লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ একে ‘আদি পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা লিখি এক, পড়ি আরেক।’ অর্থাৎ আমরা লিখি সংস্কৃত, আর ঠিক সেটা পড়ি প্রাকৃত বাংলা ভাষায়। বিশ শতক পর্যন্ত যত ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছে, তার সবই হয়েছে সংস্কৃতের আদলে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে গঠিত ‘ব্যাকরণ সমিতি’তে বিদগ্ধজনদের কাছে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন রেখেছিলেন, বাংলা ব্যাকরণ কেন সংস্কৃতমূলক হবে? তিনি জানতে চান, সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বাংলায় বেশি বলেই ভাষার গঠনাদিও সংস্কৃত ব্যাকরণানুসারে করতে হবে কেন? রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করলেন, বাংলা ভাষার প্রকৃত কাঠামো সংস্কৃত হতে পুরোপুরি আলাদা। বাংলা একটি স্বতন্ত্র ভাষা। এর উচ্চারণ, বানান ও ব্যাকরণ যে সংস্কৃত নিয়মে নয়, বাংলার নিয়মে চলবে তার জন্য রবীন্দ্রনাথ, হরিপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ ১৩০৮ বাংলা সনের দিকে বাংলা বানান ও ব্যাকরণ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করার পর অ্যাকাডেমিক সভা ডেকে বাংলা চলিত বানান প্রমিত করার প্রস্তাব করেন। তিনি প্রমিত বানান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। তার প্রস্তাব বিবেচনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে বানান সংস্কার সমিতি গঠন করা হয়। এই কমিটি ব্যাপক আলোচনা ও বহু বিজ্ঞজনের মতামত পর্যালোচনা করে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বানানের নিয়ম প্রকাশ করে। সেই বানান ব্যবস্থাই পরপর কয়েকবার সংস্কারের মাধ্যমে আজও অনুসারিত হয়ে আসছে। সেটাই এখনও আমাদের মূল ভিত্তি। রবীন্দ্রনাথ সেদিন এই উদ্যোগ না নিলে আজও আমরা সংস্কৃতের নিগড়েই পুরোপুরি বাঁধা থাকতাম।
আমরা দেখলাম, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সংস্কৃত শব্দপ্রধান সাধু ভাষার গদ্য সাহিত্যের প্রচলন হয়। সেটাই ছিল সব ধরনের লেখালেখির মাধ্যম। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই অভিযোগ উঠতে থাকে যে, এই ভাষা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষা গ্রহণের একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ তার প্রভাবে চলিত ভাষা গ্রহণ করতে থাকেন। তার মতো ব্যক্তিত্ব চলিত ভাষায় লেখালেখি শুরু করায় কলকাতা নির্ভর বাঙালি লেখকরা ধীওে ধীরে সাধু ছেড়ে চলিত ভাষায় লেখালেখি শুরু করেন। চলিত ভাষার দাপটে সাধু ভাষা পিছু হটতে থাকে। সাধু ভাষা আজ বাঙালির গবেষণার বস্তুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। নতুন ধারার এই লেখার সাথে কথা বলার জন্য প্রমিত ভাষার প্রচলন হয়। প্রমিত ভাষার মাধ্যমে ভিন্নভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার মানুষ একত্রিত হলে কথা বলতে পারে ও ভাব বিনিময় করতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ সেই ব্যক্তিত্ব, যিনি সংস্কৃতের নিগড় হতে ভাষাটাকে অনেকটাই উদ্ধার করে সত্যিকারের একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনিই সেই, যার কারণে সংস্কৃত শব্দপ্রধান সাধু ভাষার স্থলে সবার বোধগম্য চলিত ভাষা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তিনিই সেই, যিনি ভাষাটাকে বিশ্ব মাত্রায় উন্নীত করেছেন। অবশ্য তার সব চাওয়া পূরণ হয়নি। ভাষার পণ্ডিতরা তাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তিনিও এতসব পণ্ডিতদের সামনে অনেকটাই অসহায় ছিলেন। তাই তো বানান সমস্যার সমাধানের জন্য কামাল পাশার মতো একজনকে কামনা করেছিলেন। এসব পণ্ডিতরা আজও কেউ সংস্কারের কথা বললে ফোঁস করে উঠেন।
নানা অভিযোগে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়ার কথা অনেকেই বলছেন। তাকে বাদ দিতেই পারেন। তবে তিনি সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষার কবল থেকে ভাষাটাকে উদ্ধার করে চলিত ভাষার যে বাংলা ভাষা দিয়ে গিয়েছেন- সে ভাষাই আজ আপনার ভাষা, সে ভাষাতেই আপনি আজকের বাঙালি। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে তার সব সংস্কারকেও বাদ দিতে হবে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের সংস্কৃত শব্দপ্রধান সাধুভাষা নিয়ে থাকতে হবে, প্রমিত ভাষা বাদ দিয়ে শুধু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে হবে। আর তাতে আপনার বাঙালিত্ব কতটুকু থাকবে তা ভেবে দেখেছেন কি?
লেখক : ভাষাচিন্তক এবং আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী