কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি বদলে দেবে সবকিছু

: প্রদীপ সাহা
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং ধীরে ধীরে তা আমাদের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহারের দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। ২০২৩ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বড় আকারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে। চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে মিডজার্নির মতো অনেক প্রয়োজনীয় অ্যাপ তৈরি হয়েছে এরই মধ্যে। ভুয়া খবর ও নিয়ন্ত্রণের অভাব স¤পর্কে ভয়-ভীতিও বেড়ে চলেছে। ড্যাল-ই ও মিডজার্নির মতো ছবি সৃষ্টির পরিষেবার কল্যাণে ২০২২ সালের শেষের দিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ঘিরে উত্তেজনা শুরু হয়েছিল। সেসময় শুধু বর্ণনার মাধ্যমেই যেকোনো ছবি সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ২০২৩ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি করা ছবি দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। সেলফি ছবিকে চাকুরির আবেদনে সিভির উপযুক্ত করে তুলতে ‘রেমিনি’র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিকৃতির অ্যাপ ভাইরাল হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্য ও ইউরোপকেন্দ্রিক ছবি নির্মাণের কারণে এসব অ্যাপ বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে। যেমন ‘লেন্সা’ নামের অ্যাপ মহাকাশচারী, রক তারকা বা সুপারহিরো হিসেবে যেকোনো মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘ডিপফেক ইমেজ’ বা ভুয়া ছবির কারণে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤পকে পুলিশ গ্রেফতার করেছেÑ এমন ডিপফেক ছবির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। এমন ছবি ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের আবেগ নিয়ে খেলে রাজনৈতিক শিবিরে সহজেই আলোড়ন তোলা যায়। তাছাড়া অনেক শিল্পীও এমন ইমেজ জেনারেটর নিয়ে খুশি নন। তারা নিজেদের সৃষ্টিকর্ম অনলাইনে দেওয়ার পর তাদের সম্মতি ছাড়াই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল ট্রেনিংয়ের কাজে সেগুলোকে ব্যবহার করছে। এখন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইমেজের কপিরাইট সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে চ্যাটজিপিটি প্রকাশ করা হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এর সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কিছু সময়ের জন্য কনজিউমার অ্যাপ হিসেবে সেটি সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধির রেকর্ড দখল করেছিল। মাইক্রোসফট চ্যাটজিপিটি সৃষ্টিকারী ওপেনএআই কো¤পানিতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে। বিং নামের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে সেই চ্যাটবট জুড়ে এই কোম্পানি ‘বিং চ্যাট’ সৃষ্টি করেছে।

চ্যাটজিপিটির মতো অ্যাপ্লিকেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আলোচনায় আসে। সম্প্রতি ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কর্মকর্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের প্রথম আইনের একটি অস্থায়ী চুক্তিতে পৌঁছেছেন। চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর বিশ্বের প্রথম জাতীয় বিধান প্রবর্তন করেছে, যার মধ্যে অ্যালগরিদমগুলো কীভাবে তৈরি এবং স্থাপন করা যেতে পারে- সে সম্পর্কিত নিয়মগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুক্তরাজ্য একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেফটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল; সেখানে প্রযুক্তির নিরাপদ উন্নয়নের বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্রে একাধিক দেশ স্বাক্ষর করে। ২০১৯ সালে ওপেনএআই নামের একটি গবেষণা দল একটি সফটওয়্যার তৈরি করে, যেটি প্যারাগ্রাফের মাত্র কয়েকটি অর্থবহ টেক্সট লিখতে পারে। এছাড়া এ সফটওয়্যার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছু পড়ে মোটামুটি তা বুঝতে পারে, কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পারে। ওপেনএআই শুরুতে সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের তৈরি এ সফটওয়্যার (জিপিটি-টু) সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করবে না। লোকে এটি ব্যবহার করে ব্যাপক হারে অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার চালাবে। এটি খুব বিপজ্জনক। এরপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। ওপেনএআই এর জিপিটি-টু সীমিত কিছু ব্যবহারকারীর মধ্যে ছাড়া হয়। কিন্তু পরে যখন তারা জিপিটি-থ্রি বাজারে ছাড়ে, তাৎক্ষণিকভাবে সেটি সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

বর্তমানে অনেক মানুষ ই-মেইল, কোডিং ও গবেষণার জন্য নিয়মিত বিং এবং অন্যন্য চ্যাটবট ব্যবহার করেন। ব্রাজিলে চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে লেখা একটি আইনও কার্যকর করা হয়েছে। ২০২৩ সালে ‘গেম চেঞ্জার’ আসে। কৃত্রিম অডিও, কণ্ঠের নকল ও সৃজনশীল ভাবনার ফসল হিসেবে কিছু মজাদার ভিডিও আমাদের মুখে হাসি ফোটায়। তাছাড়া স্পটিফাই সম্প্রতি ‘ভয়েস ক্লোনিং’-এর মতো টুল পডকাস্টারের ক্ষমতা বাড়াতে চাচ্ছে। বিভিন্ন ভাষায় তাদের কণ্ঠ নকল করে পডকাস্টার এমন মানুষের নাগাল পাচ্ছেন, যাদের কাছে অন্যভাবে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কণ্ঠ ক্লোন করার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপফেক তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অডিও ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে নির্বাচনি প্রচারও চালানো হচ্ছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে চ্যাটজিপিটি তৈরি হওয়ার পর সারা বিশ্বে একে নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিশ্বের প্রায় দশ কোটি মানুষ বর্তমানে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছে। মার্চ ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের অস্টিনে এক সম্মেলনে বিশ্বের প্রযুক্তি খাতের নীতি-নির্ধারক, বিনিয়োগকারী এবং নির্বাহীরা অংশ নেয়। সেখানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা এবং ক্ষমতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো অসম্ভব শক্তিশালী এক প্রযুক্তির আবির্ভাব। এ ধরনের শক্তিশালী নতুন প্রযুক্তি ভালো এবং মন্দ উভয় কাজেই ব্যবহৃত হয়।

সম্প্রতি (মার্চ ২০২৪) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ‘কগনিশন’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক এক সফটওয়্যার প্রকৌশলী তৈরি করেছে। তাদের দাবি, এটাই বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার প্রকৌশলী। তারা প্রোগ্রামটির নাম দিয়েছে ‘ডেভিন। এতদিন কোনো ওয়েবসাইট বা ভিডিও তৈরির জন্য পুরোপুরি কোনো প্রোগ্রামের ওপর নির্ভর করা সম্ভব ছিল না। এ কাজে প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মীকে হাত লাগাতে হতো। কিন্তু ‘ডেভিন’ নিজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোড লেখা এবং ত্রুটি ঠিক করার কাজ করতে পারে। তারপর সেই কোডকে ওয়েবসাইট ও ভিডিওতে রূপ দিতে পারে। গত বছর (২০২৩) মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট, গিটহাব ও ওপেন এআই মিলে ‘কোপাইলট’ নামের একটি চ্যাটবট তৈরি করেছিল। চ্যাটবট হলো এক ধরনের সফটওয়্যার, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গঠন করা হয়। এটি এমন এক ধরনের চ্যাট ইন্টারফেস, যেখানে আগে থেকেই প্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে বিভিন্ন তথ্য যুক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কোপাইলটের ওপর ভিত্তি করেই ডেভিন নামের সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, একে বাড়তি নির্দেশ দিতে হয় না; একটি কমাণ্ড দিলেই পুরোপুরি ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যার প্রোগ্রামে রূপ দিতে পারবে। এছাড়া এটি ত্রুটি খুঁজে বের করতে সক্ষম, যাতে সফটওয়্যার প্রকৌশলীদের অনেক সময় বেঁচে যাবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কাজ সম্পাদন বা কোড লেখা ছাড়াও এটি নিজে থেকেই পুরো সফটওয়্যার প্রোগ্রাম শেষ করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, তবে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনযাত্রা পুরোপুরি বদলে দিবে? আমরাও কি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একদিন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পথে হাঁটব?

 

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

 

#