মানবতার কবি লালন সাঁইজির প্রত্যেকটি গানে রয়েছে মহা তাৎপর্য, জীবনাদর্শ ও মানবতাবাদী দর্শন। লালন ফকিরের একটি গানে আছে- ‘সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন/ সত্য সুপথ না চিনিলে/ পাবি নে মানুষের দরশন।’ লালন ফকিরের উক্ত সঙ্গীত একটি উন্নত মানের প্রার্থনা সঙ্গীত। এমন সুন্দর, অর্থবহ, আদর্শমুখী, মানবিক প্রার্থনা সঙ্গীত বিশ্বে বিরল। সত্য বল সুপথে চল এ ছোট একটি কথার মধ্যে নিহিত আছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শন, মুক্তির পথ। সত্য বলা, সত্য খোঁজা, সৎ পথে চলা, সৎ জীবনযাপন করা আলোকিত মানুষের লক্ষণ। সহজ সরল মানুষই সভ্য মানুষ, সহজ সরল জীবনই উন্নত জীবন, সহজ সরল মানুষই মনের মানুষ, সহজ-সরল প্রেমই আসল প্রেম, সহজ সরল কথাই সত্য কথা। সহজ সরল জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে সুখ-শান্তি, আনন্দ-স্বস্তি।
মিথ্যা ও কৃত্রিমতার মধ্যে কোন সুখ নেই, শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। বরং আছে অশান্তি, গ্লানি, অস্বস্তি। মানুষ সত্যচ্যুত হলে তার মধ্যে বাসা বাঁধে মিথ্যা, প্রতারণা, প্রতিহিংসা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। সত্য থেকে মানুষ যত দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ তত মনুষত্বহীন হয়ে পরছে, মানবতা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, রাহাজানি বেড়েই চলেছে। এতে আত্মার খোরাক বিনষ্ট হচ্ছে। আত্মার খোরাক হচ্ছে আনন্দ, প্রেম। যেখানে সততা নেই সেখানে প্রেম নেই, যেখানে প্রেম নেই সেখানে আনন্দ নেই, যেখানে আনন্দ নেই সেখানে শান্তি নেই। শান্তি পেতে হলে সত্যে ফিরে আসতে হবে, সত্য পথে চলতে হবে। সত্য কাউকে বঞ্চিত করে না। যদিও সত্য বড় কঠিন। এ জন্য লালনের মানসশিষ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/ সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আসলে সত্য কী? সহজ কথায় মিথ্যার বিপরীত হচ্ছে সত্য। আসলে সত্য একটা আদর্শ যা অনাদর্শকে দূর করে। সত্য একটা আলো যা অন্ধকার দূরীভুত করে। সত্য একটা ন্যায় যা অন্যায়কে বিতাড়িত করে। সকল ইতিবাচক গুণই সত্য। ইংরেজ কবি জন কিট্স যেমন বলেছেন, সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর (Beauty is truth, truth beauty) তেমনি সত্যই সদ্গুণ, সদ্গুণই সত্য। তবে সত্য কঠিন ও তিক্ত। তা হলেও সত্যই একমাত্র সঠিক পথ। এ জন্য বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন বলেছেন, Honesty is the best policy. লালন আরো সুন্দর ভাষায় বলেছেন, সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন। সত্যই পরম ধর্ম। সত্যের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন- এ মানুষ হচ্ছে গুরু। গুরুই শিষ্যকে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোতে আলোকিত করেন, মুক্তির পথ দেখান। তাই গুরু হচ্ছে বাউলদের কাছে সত্য মানুষ,পরম মানুষ, মুক্তিদাতা, সাক্ষাৎ দেবতা, নবি, রাসুল, অবতার। বাউল মৃত্যু মানুষের আরাধনা করেন না। বাউল আরাধনা করেন জীবিত মানুষকে। এই মানুষের মাধ্যমে সেই মানুষের সন্ধান মেলে। গুরুর মাধ্যমে মহাগুরুর সন্ধান। কিন্তু সত্য ও সুপথ ব্যতীত সেই পরম গুরুর সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব নয়। অসত্য, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা দিয়ে মনের মানুষ তথা পরম মানুষের সন্ধান মেলে না। তাই সত্য ও সুপথে জীবন পরিচালনার মধ্যে রয়েছে আত্মিক ও বাহ্যিক মুক্তি, শান্তির সুবাতাস। সত্য হচ্ছে মুক্তির দর্শন। সত্য জানলে, সত্য পথ অনুসরণ করলে, সত্যকে আলিঙ্গন করলে সত্য মুক্তির পথ বাতলে দেয়। সত্যের মধ্যে রয়েছে মুক্তি, মানসিক প্রশান্তি। সৎ পথের অনুশীলনে মানুষের অন্তরে প্রজ্ঞা ও পরমজ্ঞানের সঞ্চার হয়।
সত্য হচ্ছে আলো। যিনি সৎ তিনিই সাধু তিনিই আলোকিত। যিনি আলোকিত তিনিই পথ দেখাতে পারেন। আলো যেখানে অন্ধকার সেখান থেকে এমনিতে দূরে সরে যায়। যিনি সত্য ধারণ করেন, লালন করেন ও পালন করেন তিনি সাধু। যিনি পরের মঙ্গল করেন তিনিও সাধু। সাধু বা আলোকিত মানুষ হচ্ছেন পরের মঙ্গলে নিবেদিত প্রাণ। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘কে’ কবিতায় সাধুর সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেন, বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,/ পরের যে ভাল করে, সাধু বলি তারে।
পরের ভালো করাই পরম ধর্ম। এর চেয়ে বড় দর্শন আর কী হতে পারে? টমাস পেইন ‘Rights of Man’ গ্রন্থে বলেন, To do good is my religion. . সাধুর গুণ বলে শেষ করা যায় না। চন্দনের স্পর্শে যেমন অন্যান কাঠেও চন্দনের গন্ধ পাওয়া যায়, তেমনি সাধু দর্শনে, সাধুর স্পর্শে অসাধুও সাধু বনে যান। মহৎ গুণ সম্পন্ন সাধু হচ্ছেন সাত্ত্বিক মহাপুরুষ। লালন সাঁইজি বলেন, সাধুর গুণ যায় না বলা/ শুদ্ধ চিত্ত অন্তর খোলা।/ সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা/ পরশে প্রেমতরঙ্গ। সাধু মানুষ, আলোকিত মানুষই মনের মানুষ। এই মনের মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়ার আকাঙ্খা চিরকাল। লালন শিষ্য গগণ হরকরা তাই বলেন, আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনে মানুষ যে রে।
মানুষ সত্যবাদী হলে তার পক্ষে অন্যায় করা অসম্ভব। সকল অপকর্মের সাথে মিথ্যা জড়িত। আসলে লালনের সত্য বল সুপথে চল এ এক বাক্যের মধ্যে মানুষের যাবতীয় গুণ নিহিত রয়েছে। সত্যের মধ্যে রয়েছে শৃঙ্খলা, ন্যায়, মানবতা, আনন্দ। ভব যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার ঔষুধ হচ্ছে সত্য। এ ঔষুধ শুধু এ কালে নয়, পরকালেও কাজ দেবে। সত্য থেকে বিচ্যুত হলেই বিপদ। তাতে মুক্তি অসম্ভব। লালন বলেন, ‘পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ কর না/ পারে যেতে পারবে না।’
সম্পদ ও নারীর প্রতি মানুষের রয়েছে দারুণ আকর্ষণ, লোভ। মানুষের পক্ষে এ লোভ সামলান ভারী কষ্টকর। নারী ও ধন-সম্পদ নিয়ে মানুষের কাড়াকারি, মারামারি। তাই লালন বলেন, পরের জিনিস, পরের নারী হরণ করো না মানে লুণ্ঠন করো না, কেড়ে নিয়ো না। কেননা এ সব লুণ্ঠন করলে সমাজে ন্যায়-নীতি বলতে কিছু থাকে না। সমাজে অশান্তি অরাজকতা জায়গা করে নেয়। তাছাড়া যে লুণ্ঠন করে তারও কি রেহাই আছে? তাকেও মামলা মুকাদ্দমা, থানা-পুলিশ, সালিশ দরবার, বিরূপ সমালোচনার ধকল সইতে হয়। এ আরেক অশান্তি। অশান্তিই মরণ। মরণে রয়েছে যন্ত্রণা, যন্ত্রণায় অশান্তি। শান্তি মেলে আনন্দে, আনন্দ মেলে প্রেমে। জোর করে কি প্রেম পাওয়া যায়?
লালন ফকির শুধু সত্যবাদী হতে বলেন নি, জীবনকে সুপথে চালিত করতে আহবান জানিয়েছেন। ‘সত্য বল, সুপথে চল, ওরে আমার মন ‘ প্রতিটি ধর্মের সার কথাই তো এটা। ধার্মিকরা ধর্মের সার কথা বাদ দিয়ে ধর্মের বহিরাবরণ বাস্তবায়নে অস্থির হয়ে ছুটছে। ফলে একদিকে ধর্মের আড়ম্বর বাড়ছে, অন্যদিকে তা অন্তঃসারশূন্য হয়ে পরেছে, সত্য লুপ্ত হচ্ছে। সমাজে সত্যের দুর্ভিক্ষ চলছে। সত্য নয়, স্বার্থই এখন বড় পুঁজি। সত্য কেউ ধারণ করে না, পালন করে না, লালন করে না। তাই তো লালন সাঁইজি বলেন, সত্য বলতে কেই নয় রাজি/ সবই দেখি তা না না না/ জাত গেল জাত গেল বলে/ এ কি আজব কারখানা। সত্য থেকে মানুষ যখন দূরে সরে যায় তখন সে জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নিয়ে, ইবাদত-উপাসনা পদ্ধতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আসল বাদ দিয়ে নকল নিয়ে টানাটানি। সত্য থেকে দূরে থাকা মানে অন্ধকারে, আড়ম্বরে, কুবিশ্বাসে- কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকা।
সততা ও নৈতিকতার বলেই মানুষ। এ আদর্শ না থাকলে সভ্যতা বলে কিছু থাকে না। সততাই স্বর্গ, মিথ্যাই নরক। আমরা যদি সৎ হই, তাহলে পরকালের স্বর্গের অপেক্ষা নয়, ইহজগতের পৃথিবীই হবে স্বর্গ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস, সম্পাদক, এনসিটিবি