মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা

: স্বপ্নীল ফিরোজ
প্রকাশ: ২ মাস আগে

বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার মুল্যায়ন :

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনায় আসলে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে একসময় সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি পর্যন্ত, প্রতিটি আন্দোলনেই আওয়ামী লীগের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই দলটি বাংলার মানুষের জন্য স্বাধীনতার পথ তৈরি করে দিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য একতাবদ্ধ করেছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং প্রবাসী সরকারের ভূমিকা অপরিসীম ছিল। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে তাদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।

যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হত :

আজকে যারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে, সরকারের উচ্চপদে থেকে দেশের নীতিনির্ধারণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের হয়তো কল্পনা করাও কঠিন, যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তবে তাদের জীবনের পরিস্থিতি কেমন হতে পারত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবন তখন কেমন হতে পারত, সে প্রসঙ্গটি ভেবে দেখা জরুরি।

স্বাধীনতা অর্জিত না হলে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক শোষণের শিকার হতে থাকত। বাঙালি জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সবসময়ই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উচ্চপদে চাকরি, শিল্প-বাণিজ্যের সুযোগ, এমনকি সমাজের নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য কোনো জায়গা থাকত না। তখনকার শাসকগোষ্ঠী চেয়েছিল বাঙালিদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে, তাদের শোষণের মাধ্যমেই তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধ করতে।

আজ যারা প্রশাসনের উঁচু পদে আছেন, যদি দেশ স্বাধীন না হতো তবে হয়তো তারা সরকারি অফিসে নিম্ন স্তরের কর্মচারী হতেন। কেউ হতেন অফিসের আর্দালি, কেউ কোনো সাহেবের কোচওয়ান, কেউ বা প্রভাবশালী উকিলের মুহুরি। উচ্চশিক্ষা অর্জন করলেও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ পেতেন না, কারণ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন এবং সম্ভাব্য জীবন :

যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হত, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানিদের জীবন দাসত্বের মধ্যে আটকে থাকত। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সবকিছু শোষণ করত। পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী সবাই বাধ্য হতো বৈষম্যের জীবনযাপন করতে। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং পরিচয় ধ্বংস করার নানা অপচেষ্টা চালানো হতো।

বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এদেশের মানুষ যে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে যে উন্নতির সোপানে উঠেছে, তা কখনোই সম্ভব হতো না। উচ্চশিক্ষার সুযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন- সবই সম্ভব হয়েছে কারণ আমরা স্বাধীন। অথচ যারা আজ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে দেশের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা হয়তো ভুলে গেছেন, যদি না হতো স্বাধীন এ বাংলাদেশ, তবে তাদের জীবনও হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন।

স্বাধীনতার অমূল্য চেতনা, বিশ্বব্যাপী উদাহরণ :

স্বাধীনতা যে কী অমূল্য ধন, তা বুঝতে হবে তাদের কাছ থেকে যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে কিন্তু এখনো সফল হয়নি। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন এবং কুর্দি জাতির কথা বললেই বোঝা যায়, তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তা থাকা সত্ত্বেও তারা আজও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। তাদের এই সংগ্রাম, তাদের এই বঞ্চনা স্বাধীনতার মূল্য কতটা অমূল্য তা উপলব্ধি করাতে সাহায্য করে।

অথচ বাংলাদেশের মতো একটি জাতি মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। কিংবদন্তি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব এবং মহামতি ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতা এই বিজয়কে সম্ভব করেছে। হয়তো এত সহজে স্বাধীনতা অর্জন করায় আমরা এর প্রকৃত মুল্যায়ন সবসময় করতে পারি না।

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির লজ্জাজনক ভূমিকা :

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় হচ্ছে এদেশের কিছু মানুষ যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। রাজাকার, আলবদর, এবং জামাতে ইসলামী ঐ সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করেছিল। অথচ আজ এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশে তারা নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, যা আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অশ্রদ্ধার শামিল।

বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং স্বাধীনতার মূল্য :

আওয়ামী লীগ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অবদান রেখেছে তা নয়, স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারায় বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার, যা তার উত্তরসূরীরা বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেছে।

কিন্তু এদেশের মানুষ আজও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কেউ কেউ সমালোচনা করে যে আওয়ামী লীগ অতিরিক্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে এবং গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও সহনশীল ও স্বচ্ছ হতে হবে, এবং জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

পরিশেষে :

স্বাধীনতা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান, এবং তা বুঝতে হলে আমাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না। স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তিও বয়ে এনেছে। আজকের বাংলাদেশ, যে দেশের মানুষ শিক্ষিত, কর্মদক্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক, তা সম্ভব হয়েছে কারণ আমরা স্বাধীন।

সুতরাং, আমাদের দায়িত্ব হলো স্বাধীনতার মুল্যায়ন করা, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সেই অর্জনকে রক্ষা করা। যারা আজ বড় বড় পদে বসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের অবস্থানও স্বাধীনতার ফল। সেই কারণে তাদেরও উচিত সেই স্বাধীনতার মূল্য ঠিকমতো বোঝা এবং তার মর্যাদা রক্ষা করা।

 লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী

  • প্রেক্ষাপট
  • মুক্তিযুদ্ধ
  • স্বাধীনতা
  • #