নববর্ষ সকল দেশের, সকল জাতিরই আনন্দ ও উৎসবের দিন। শুধু আনন্দ উচ্ছ্বাস-ই না, সকল মানুষের জন্য কল্যাণ কামনার দিনও। বাংলা সনের প্রথম মাসের নাম বৈশাখ মাস। এই দিন বাংলা নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির এক অনন্য উৎসব। এটি আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসব। আমরা সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়েই মহাধুমধামের সঙ্গে আমাদের নববর্ষ উৎসব উদযাপন করি। একে অন্যকে শুভেচ্ছা দেই, বলি- শুভ নববর্ষ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে, সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে, সব সংস্কৃতিতেই নববর্ষ উদ্যাপনের প্রথা প্রচলিত আছে। অবশ্য উদ্যাপনের প্রকাশ রীতি-প্রকৃতি ও পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে। এক সময় গ্রাম নগর নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক, বাংলা নববর্ষের উৎসবে সোৎসাহে যোগ দিত। পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছ বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব মেলা ও প্রদর্শনী মিলে সারা বছরের অন্যান্য দিনগুলো থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে এই দিনটি গৌরবময় হয়ে উঠত। কালের বিবর্তনে এখন অবশ্য বর্ষবরণরীতিতে কিছু সংযোজন বিয়োজন হয়েছে। তবে সর্বক্ষেত্রেই একটি মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে। তা হল নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরনো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।।
সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণ। মূলত সংস্কৃতির লোকজ রীতিনীতি ও বৈশিষ্ট্যের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে চেনা ও জানা যায়। সংস্কৃতি বলতে আমরা সাধারণত সাহিত্য, শিল্প, নৃত্যগীতিবাদ্যকে বুঝে থাকি। এগুলো সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ। তবে এগুলোই সংস্কৃতির সবটা নয়। সংস্কৃতি বলতে মুখ্যত দুটো ব্যাপার বোঝায় : বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানস-সংস্কৃতি। ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, আহার-বিহার, জীবনযাপন প্রণালি এসব বস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্গত। আর সাহিত্য-দর্শনে, শিল্পে-সঙ্গীতে মানসিক প্রবৃত্তির যে প্রকাশ ঘটে, তাকে বলা হয় মানস সংস্কৃতি। বস্তুগত আর মানস-সংস্কৃতি মিলিয়েই কোনো দেশের বা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি, তা অনেক পুরনো। নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে, ধর্মানুপ্রেরণায়, বর্ণপ্রথায়, উৎপাদন-পদ্ধতির অনেকখানিতে বাঙালি সংস্কৃতির মিল পাওয়া যাবে গোটা উপমহাদেশের সঙ্গে। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম বহুলপঠিত ও জনপ্রিয় একটি ভাষা। এই গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাংলার অনেক রীতিনীতিরও মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই এলাকায়। আবার ধান-তেল-হলদি-পান-সুপারির ব্যবহারের মিল পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে।
বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিতে দান করেছে স্বাতন্ত্র্য। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দরুন বাংলায় বিভিন্ন রাজত্ব যেমন স্থায়িত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি বাংলার এই বিচ্ছিন্নতার ফলে ধর্মমতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও উদ্ভাবন দেখা দিয়েছে। বাংলার সাহিত্য-সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য গান করে লেখা ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের উদ্ভব পূর্ববঙ্গের জলাভূমি, পশ্চিম বঙ্গের রুক্ষ মাটিতে বিকাশ বৈষ্ণব পদাবলী। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি গানের বিস্তার, শুষ্ক উত্তর বঙ্গে ভাওয়াইয়ার, আর বাংলা পশ্চিমাঞ্চলে কীর্তন ও বাউলের। শিল্পসামগ্রীর লভ্যতাও প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই বাংলার স্থাপত্যে পাথরের চেয়ে ইট আর মাটির প্রাধান্য, মৃৎফলক এখানকার অনন্য সৃষ্টি। বাংলার ভাস্কর্যেও মাটির প্রাধান্য, আর সেই সঙ্গে দেখা যায় এক ধরনের সামগ্রীর ওপর অন্য ধরনের সামগ্রীর উপযোগী শিল্প সৃষ্টির প্রয়াস। অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বাংলার মানস-সংস্কৃতি প্রধানত আশ্রয় করেছে সাহিত্য ও সংগীত, অধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে। স্বল্প হলেও স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলার দান আছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিতের সাধনার তেমন ঐতিহ্য বাংলায় গড়ে ওঠেনি।
বাঙালি সংস্কৃতিতে উৎসব একটি বড় বিষয়। এদেশে বিভিন্ন ধরনের উৎসব পালিত হয়ে থাকে। জাতীয় উৎসব যেমন, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শিশু দিবস, জাতীয় শোক দিবস ইত্যাদি। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে ঈদ, পূজাপার্বণ, বড়দিন, ইস্টার সানডে, মাঘি পূর্ণিমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের লোকজ উৎসব সারাদেশের নানা প্রান্তে উদযাপিত হয়। বাংলাদেশের সর্বজনীন উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদযাপন। বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস এখনো সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতই মনে করেন মুঘল সম্রাট আকবর চান্দ্র হিজরি সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌরসনের সমন্বয় সাধন করে ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের জনগণের নওরোজ বলে উল্লেখ করেছেন।
বিভাগোত্তর পূর্ব-বাংলায় বাঙালিকে বর্ষবরণ উৎসব পালন করতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, এটা পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থি। সে-বক্তব্য ছিল সংস্কৃতির ওপর চরম আঘাত। বাঙালি তার সংস্কৃতির ওপর এ আঘাত সহ্য করেনি। পূর্ব-বাংলার বাঙালিরা ফুঁসে উঠেছে। সোচ্চার হয়েছে প্রতিবাদে। এভাবেই পূর্ব-বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাঙালি জাতিসত্তার গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বাংলা নববর্ষ এবং তার উদযাপনের আয়োজন।
১৯৫৪ সালের পূর্ব-বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারকে বিপুলভাবে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠিত হলে মুখ্যমন্ত্রী ও বাঙালিদের জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। পাকিস্তান আমলে সরকারিভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়নি। কিন্তু বেসরকারিভাবে উদযাপিত হয়েছে প্রবল আগ্রহ ও গভীরতর উৎসাহ-উদ্দীপনায়। এর মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট (প্রতিষ্ঠা : ১৯৬১)। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার পাকুড়মূলে ছায়ানট নববর্ষের যে উৎসব শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাধাহীন পরিবেশে এখন তা জনগণের বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনাময় অংশগ্রহণে দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকার নববর্ষ উৎসবের দ্বিতীয় প্রধান আকর্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় মুখোশ, কার্টুনসহ যে সব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকধর্মী চিত্র বহন করা হয় তাতে আবহমান বাঙালিত্বের পরিচয় এবং সমকালীন সমাজ-রাজনীতির সমালোচনাও থাকে।
বাংলা সন চালু হবার পর নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা চালু হয়। নবাব আর জমিদারেরা চালু করেন পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। পয়লা বৈশাখে প্রজারা নবাব বা জমিদার বাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন, তাদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। পান-সুপারিরও আয়োজন থাকত। তবে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায়। মুরশিদাবাদের নবাবেরা এ অনুষ্ঠান করতেন। বাংলার জমিদারেরাও করতেন এ অনুষ্ঠান। জমিদারি উঠে যাওয়ায় এ অনুষ্ঠান এখন লুপ্ত হয়েছে।
পয়লা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল ‘হালখাতা’। ব্যবসায়ীরা এ অনুষ্ঠানটি করতেন এবং এখনো করেন। নববর্ষ উপলক্ষ্যে দোকানিরা নতুন খাতা খোলার উৎসব করতেন। হালখাতাকে কেন্দ্র করে দোকানিরা ঝালর কাটা লাল নীল সবুজ বেগুনি কাগজ দিয়ে দোকান সাজাতেন। ধূপধুনা জ্বালানো হতো। মিষ্টিমুখ করানো হতো গ্রাহক খরিদ্দারদের। হাসি-ঠাট্টা, গল্পগাঁথার মধ্যে বকেয়া আদায় ও উৎসবে আনন্দ উপভোগ দুই-ই সম্পন্ন হতো। হালখাতাও এখন আর তেমন সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় না। এখন মানুষের হাতে নগদ পয়সা আছে। বাকিতে বিকিকিনি এখন আর আগের মতো ব্যাপক আকারে হয় না।
বাংলা নববর্ষের একটি প্রধান অনুষ্ঠান হলো বৈশাখী মেলা। দেশের নানা স্থানে বৈশাখের প্রথম দিনে বার্ষিক মেলা বসে। এইসব মেলার অনেকগুলোই বেশ পুরনো। এই মেলাগুলোর মধ্যে খুব প্রাচীন ঠকুরগাঁ জেলার রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদের মেলা এবং চট্টগ্রামের মহামুনির বৌদ্ধপূর্ণিমার মেলা। আগে এইসব আঞ্চলিক মেলা থেকেই মানুষ সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখত। তাছাড়া এইসব মেলা অঞ্চলবিশেষের মানুষের মিলন মেলায়ও পরিণত হতো। নানা সংবাদ আদান-প্রদান, নানা বিষয়ে মতবিনিময়েরও আদর্শ স্থান ছিল এই সব মেলা। আবার বাৎসরিক বিনোদনের জায়গাও ছিল মেলা। মেলায় থাকত কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুলনাচ, নাগরদোলাসহ নানা আনন্দ আয়োজন।
নববর্ষের ওই তিনটি প্রধান সর্বজনীন উৎসব ছাড়াও বহু আঞ্চলিক উৎসব রয়েছে। এদর মধ্যে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত বলী খেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘আমানি’ নববর্ষের একটি সুপ্রাচীন আঞ্চলিক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকাতেও নববর্ষের উৎসব হয় নানা আনন্দময় ক্রীড়া-কৌতুকের মধ্য দিয়ে। এরা বৈসুব, সাংগ্রাই ও বিজু এই তিনটি অনুষ্ঠানকে একত্র করে ‘বৈসাবী’ নামে উৎসব করে। গ্রাম-বাংলায় নববর্ষ উপলক্ষ্যে নানা খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। আগের দিনে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জে হতো গরুর দৌড়, হাডুডু খেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোরগের লড়াই, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, নড়াইল জেলায় ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি অনুষ্ঠান পালিত হতো।
নববর্ষ উৎসব ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর নতুন গুরুত্ব ও তাৎপর্য লাভ করে। এছাড়া বাংলা একাডেমিতে বৈশাখী ও কারুপণ্য মেলা এবং গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকা পয়লা বৈশাখের দিনে লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছেলেরা এবং নানা রঙের শাড়ি পড়ে মেয়েরা এই অনুষ্ঠানকে আরও বর্ণিল করে তোলে। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলের গান, লোকসংগীত এবং বাঁশির সুরে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সমবেত সবাই। আনন্দময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ এই পরিবেশ আধুনিক বাঙালি জীবনের এক গৌরবময় বিষয়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অপরাজেয় শক্তি ও মহিমায় পূর্ণ করুক, এই হোক আমাদের শুভ কামনা।
লেখক : এমফিল গবেষক