রাজনীতিতে মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডার রাজনীতি

: স্বপ্নীল ফিরোজ
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’- কবি রফিক আজাদের বিখ্যাত কাব্যিক উক্তি যা বাংলাসাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।মূলত কবিতাটি লিখিত হয়েছিল একটি প্রোপাগাণ্ডা এবং মিথ্যে ষড়যন্ত্রের উপর ভিত্তি করে। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিশ্বমঞ্চে নাজেহাল এবং ব্যর্থ প্রমাণের লক্ষ্যে একটি মাস্টারমাইন্ড নীলনক্সার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার অনুভূতি।
সমাজের একটি ধুরন্ধর বিশেষ মহল তারা জানে যোগ্যতার মাপকাঠিতে তারা কখনোই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আরোহন করতে পারবে না। তাই তারা ষড়যন্ত্রের পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট হয়। সাময়িকভাবে তাদের চক্রান্ত সফল হলেও শেষ পর্যন্ত তারা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।পতঙ্গপ্রাণের কাছে আগুন যেমন, ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে ক্ষমতা তেমন, চুড়ান্ত হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে কেড়ে নেয় সাধের জীবন। তাই ইতিহাসকে বলা হয় এমন এক বিদ্যালয় যা থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে দেখা যায় রফিক আজাদের কবিতার মতোই ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যে এজেন্ডা এবং প্রতারণার ভেতর দিয়ে শক্তিশালী এক গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এবং যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

ইতিহাসের অনেক বড় বড় পট পরিবর্তন হয়েছে শুধু মিথ্যে-প্রপাগান্ডার গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে। প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় আনতে চাই সেই- বাসন্তী-দুর্গতিকে। যেখানে জাল পরিয়ে ছবি তোলে চক্রান্তকারীরা বিশ্বদরবারে বঙ্গবন্ধু সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছিল, সেই প্রসঙ্গ।

স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪ সাল। যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ভীষণভাবে ভঙ্গুর, নাজুক এবং অস্থিতিশীল। সে-সময় পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দীর্ঘ বন্যা মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে এমনিতেই বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছিল। আর এ সময়টিকেই কুচক্রীমহলের হোতা তৎকালীন ইত্তেফাকের সম্পাদক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন (মানিক মিয়া সাহেবের বড় পুত্র) ১৯৭৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইত্তেফাকে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিশ্বদরবারে ব্যর্থ প্রমাণ করার লক্ষ্যে বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাসন্তী এবং তাঁর চাচাতো বোন দুর্গতিকে জাল পরিয়ে সেই কুখ্যাত ছবিটি তিনি সেদিন প্রকাশ করেন। ছবিটি তুলেছিলেন ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদ।

ইতিহাস থেকে আমরা জানি, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে পাকিস্তান আমল, ব্রিটিশ আমল এবং তারও অনেক পূর্ব থেকেই এসব অঞ্চলে বছরে দু-একবার মঙ্গার কবলে পড়তো। আর তারা এ সময়টিকেই বেছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিতে। ’৭৪ এ যখন বাসন্তীকে জাল পরিয়ে ছবিটি তোলা হয় তখন ছিল বর্ষাকাল। চারিদিকে থইথই পানি।
সেসময় একদিন ব্রহ্মপুত্র নদের পারে প্রতিবন্ধী বাসন্তী এবং তাঁর চাচাতো বোন দুর্গতিকে তাদের পরিহিত শাড়ির উপর জাল পরিয়ে আলোকচিত্রী আফতাব হোসেন ছবিটি তোলেন। ছবিটি তোলার সময় তিনি বলেন, ‘তোমরা মুখে কিছু পাটপাতা চিবুতে থাকো। ছবিটি দেখে যাতে মানুষের মনে হয় তারা চরম ক্ষুধার্ত এবং সীমাহীন দারিদ্র্যতায় দিনাতিপাত করছেন। ষড়যন্ত্রের সেই মিথ্যে ছবিটি নিয়ে পৃথিবীব্যাপী বঙ্গবন্ধু সরকারের ব্যাপক নিন্দে ছড়িয়ে পড়ে। কবি রফিক আজাদ তখন এই ক্রোড়পত্রটি পড়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়- ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাব।’ কবিতাটি লিখে বিখ্যাত বনে যান। যদিও মিথ্যের উপর ভর করে এ কবিতাটির জন্ম তবুও আজ অবধি কিছু কিছু কুচক্রীমহল প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে এখনো বঙ্গবন্ধু সরকারকে লক্ষ্য করে এ লাইন দু’টি আওড়ে বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস- সেই কুখ্যাত আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদ তাঁর নিজ বাড়িতে তাঁরই কাজের ছেলের ছুরির আঘাতে নৃশংসভাবে খুন হোন।

বর্তমান বাংলাদেশের দখলদার ইউনূস সরকারও মিথ্যে ষড়যন্ত্র এবং মাস্টারমাইন্ডদের দ্বারা ছাত্র-জনতার লাশ ফেলে সুকৌশলে সে দায় চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের উপর। আর আমাদের পতঙ্গপ্রাণ জনতা প্রকৃত ঘটনা না জেনেই সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে এবং যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। সময় গড়িয়েছে এবং বেরিয়ে পড়েছে থলের বিড়াল। মানুষ এখন তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। দখলদার ইউনূস সরকার এবং তার দোসরগণ কীভাবে একটি সাজানো গুছানো দেশকে মাত্র ১০০ দিনে ধবংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে!

ইতিমধ্যেই নেদারল্যান্ডে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারী আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট) বাংলাদেশের দখলদার সরকারের কথিত প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনুস এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে রোম সংবিধির ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিলেটের মেয়র জনাব আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

উল্লেখ্য এই মূল অভিযোগপত্রের সাথে প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার তথ্য-নথি-পত্র প্রমাণস্বরূপ যুক্ত করা হয়। যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে ড. ইউনুসের আত্মস্বীকৃত মাস্টারমাইন্ডদের দ্বারা গত ৫ ই অগাস্ট থেকে ৮ই অগাস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সমস্ত নেতাকর্মী, বাংলাদেশের বসবাসরত হিন্দু-খৃষ্ঠান-বৌদ্ধ এবং বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর উপর নির্মম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মত আন্তর্জাতিক অপরাধ সংগঠিত করে যেখানে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, ধর্ষন, দেশত্যাগে বাধ্য এবং লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি, সম্পদ ইত্যাদি বিনষ্ট করা হয়।

ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কখনোই ভালো হয় না। পৃথিবীর ইতিহাস এমনই নির্মম। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ভোগ করেন ভয়াবহ করুণ সমাপ্তি। সবারই ভাগ্যে জুটে কোন না কোন অতীব-নিদারুণ মৃত্যু। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, দেখা যাক- প্রতারক, ক্ষমতালোভী এবং খুনিদের মাস্টারমাইন্ড সমন্নয়কগণ কতদিন বেঁচে থাকতে পারে ফাঁসিকাষ্ঠের হাতছানি থেকে।

 লেখক : টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
  • ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো
  • রফিক আজাদ
  • #