ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার : শত দিনে শত শত সাংবাদিকের ক্যারিয়ার ধ্বংস

: শার্লট জ্যাকমার্ট
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে
ছবি : শার্লট জ্যাকমার্ট (সংগৃহীত)

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এমন বর্বর আক্রমণ বাংলাদেশ আর কখনো দেখেনি।
সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বাংলাদেশে সবসময়ই কঠিন পথে হাঁটতে হয়েছে। বিগত সব সরকারের আমল আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা সামরিক-ই হোক; গণতন্ত্র কাগজে-কলমে কিন্তু বাস্তবে শাসকদের আয়রন ফিস্টের মধ্যে থেকে দেশে সাংবাদিকরা কাজ করে, কখনোই তারা বিপদমুক্ত ছিল না। চলতি বছরে সর্বশেষ প্রেস ফ্রিডম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। মাত্র ৯ বছর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ১৪৫তম অবস্থানে ছিল।

আর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশের গণমাধ্যমের প্রতি বর্তমানের বিদ্বেষপূরর্ণ আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে দেশটি তালিকায় আরও নিচে নামবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৩০০ জনেরও বেশি জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই একাধিক মামলার মুখোমুখি। আর্টিকেল নাইনটিন আন্দোলনের আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মঞ্জুর বলছেন, এ সংখ্যা এখনও বাড়ছে। গত সরকারের সময়ে অভ্যুত্থানে অনেক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জন্য সাংবাদিকদের নির্বিচারে দায়ী করা হচ্ছে। অভিযুক্ত সাংবাদিকদের অধিকাংশই গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেলেও সকলেই তাদের চাকরি হারিয়েছেন, তাদের আয়, তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়েছে। অবশ্য এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের কারও কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু খুনের মামলায় তাদের নাম আসে এবং একই মামলায় আরও ২০০ জনের মতো আসামি হয়। প্রায়শই তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একই দিনে, প্রায় একই সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন খুনের অভিযোগে আসামি হয়েছেন।

এসব মিথ্যা হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত পাঁচ আসামি কারাগারে বন্দি আছেন। তারা ঢাকার উপকণ্ঠে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত ফারজানা রুপা, তার স্বামী শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত।

সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা-শাকিল আহমেদের মামলা থেকে বিশেষভাবে জানা যায় যা খুবই বিরক্তিকর, ফ্রান্সের আমন্ত্রণে বৈধভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করার সময় আগস্টের শেষের দিকে বিমানবন্দরে এই দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিক দম্পতির বিরুদ্ধে বানোয়াট হত্যা মামলা হয়। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই, তবুও তারা তিনমাস ধরে কারাগারে আছেন, নাবালিকা বাচ্চাদের বাড়িতে একা থাকতে হচ্ছে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), দ্য কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) এবং বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা তাদের অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে। শুধু তাই নয় অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ‘ফ্যাসিস্টদের’ দোসর বলে মনে-করা সাংবাদিকদের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে। এ সরকার অনেক সাংবাদিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে, যাতে সাংবাদিকরা তাদের নিজস্ব অর্থ ব্যবহার করতে না পারে। এছাড়াও, ১৬৭ জন সাংবাদিকের সচিবালয়ে প্রবেশাধিকারের প্রেস কার্ড বাতিল করা হয়েছে। ২৭ জন সাংবাদিকের জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে।

অবশ্যই, এসব সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়েছে, তারা কাউকে হত্যা করেছে এজন্য নয়, বরং তারা উদার চিন্তার ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সমর্থক। যারা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন- তাদের হয়রানি করা হচ্ছে, মারধর করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে, হত্যা মামলা দিয়ে জেলবন্দি করে পচানো হচ্ছে।

আজকাল ঢাকার রাস্তায় কেউ হাঁটলে, যেমনটা আমি গত এক সপ্তাহ ধরে করছি- দেখবেন, সাংবাদিকতা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এখানে। বিশেষ করে নারী সাংবাদিকরা হুমকির মুখে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, বিক্ষোভের নিউজ কভার করা যুবতী নারী সাংবাদিকদের উপর উচ্ছৃঙ্খল জনতা আক্রমণ করছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো উদারপন্থি সংবাদপত্রের সামনে জনতা বসে দৈনিক দুটি বন্ধের দাবিতে এবং মাহফুজ আনামের (সম্পাদক) ফাঁসি দিতে হবে স্লোগান দিচ্ছে। ঠিক গত রবিবার, ইসলামিক বিক্ষোভকারীরা আবারও ‘ভারতপন্থি’ আখ্যা দিয়ে এ পত্রিকা বন্ধের দাবিতে প্রথম আলো অফিসের সামনে গরু জবাই করে।

কেন একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে এত জঘন্যভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে? উত্তরটা সহজ- ড. ইউনূসের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ন্ত্রণে নেই। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে ইসলামি চরমপন্থি রয়েছে, তারা উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ সবকিছুর বিরুদ্ধে। তারা আগামী নির্বাচনের আগে যতটা সম্ভব উদারপন্থি কণ্ঠকে নিস্তেজ করতে চান। এরই মধ্যে তাদের উপস্থিতি কতটা শক্তিশালী তা ঢাকার রাস্তায় আরও দেখা যায়- মেয়ে ও নারীরা অনেকাংশে উধাও হয়ে গেছে। নারীরা হয়রানির অভিযোগ করেন, স্কুলে যেতে বাধা দেওয়া হয়, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। অনেক নারী বাড়িতে থাকেন, অদৃশ্য হওয়ার চেষ্টা করেন, কিংবা বাইরে যাওয়ার সময় হিজাব পরেন। মাত্র ছয়মাস আগেও এমনটা কল্পনার বাইরে ছিল।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না- একমাত্র কারাবন্দি নারী সাংবাদিক ফারজানা রুপাকে কারাগারে রাখা হয়েছে; কারণ তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। একজন স্পষ্টভাষী, সাহসী নারী হিসেবে যিনি তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে বিশেষ করে নারীদের সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কারাগারে তার চিকিৎসা হাজারেরও বেশি শব্দ উচ্চারণ করে : পুরুষ সিনিয়র সাংবাদিকরা সাধারণত ন্যূনতম আসবাবপত্র এবং নিজস্ব বাথরুমসহ একটি সেল পান। কিন্তু ফারজানা রুপাকে আরও ৩০ জন নারীর সঙ্গে একটি কক্ষে (সেল) রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো চেয়ার নেই, টেবিল নেই, খাট নেই। তাকে মেঝেতে বসবাস করতে হচ্ছে। কারাগারে তার দুর্ভোগ দেশের অন্যান্য নারী সাংবাদিকদের জন্য একটি সতর্কতা হওয়া উচিত।

অন্তবর্তী সরকারের মধ্যে ভিন্নমতের মাত্রা তার নিজস্ব আলাপে দেখা যায়- ২১ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ডেইলি স্টারের একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন- প্রমাণ ছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাগুলো ‘অন্যায়’ এবং ‘তাড়াহুড়া’ করা হয়েছে। তিনি তাদের থামাতে চান। কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যে যাদের ক্যারিয়ার ইতিমধ্যেই চুরমার হয়েছে- তাদের জন্য একটি প্লেবুক বা তিনি কীভাবে এগিয়ে যেতে চান তার একটি টাইমলাইন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক সংবাদসম্মেলনে বলেছেন, ‘গত ১৫ বছরের সব সাংবাদিকের রিপোর্ট খতিয়ে দেখতে হবে। তারা ‘ফ্যাসিবাদী আখ্যান’ ধারণ করেন কিনা। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে গণমাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের কোনো স্থান থাকবে না। বার্তাটি স্পষ্ট- আপনি যদি আমাদের সঙ্গে না থাকেন তবে আপনি আমাদের বিরুদ্ধে , সংজ্ঞা অনুসারে আপনি একজন ফ্যাসিবাদী।’

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূসের অধীনে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত হামলা প্রমাণ করে- ইসলামি আন্দোলন দেশকে হাইজ্যাক করেছে। তারা ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মুহূর্তটি দখল করে নিচ্ছে। যেটি তারা সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে আসছে এবং বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গত সপ্তাহে ঢাকায় আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের দোরগোড়ায় গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা। গত শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে সামরিক শক্তি, পুলিশ, সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একত্রিত হয়েছিল, অনেকে বুঝতে শুরু করেছে। অভ্যুত্থানের তিনমাস পরে তারা যে ফলাফল দেখতে পাচ্ছে, তাতে তারা মোটেও সন্তুষ্ট নন।

লেখক : শার্লট জ্যাকমার্ট, সিনিয়র সম্পাদক, সুইস পাবলিক রেডিও

(দ্য ভয়েস থেকে সংগৃহীত, অনুবাদ : ইমামুল ইসলাম)

  • অন্তবর্তী সরকার
  • গণমাধ্যম
  • ড. ইউনূস
  • শার্লট জ্যাকমার্ট
  • সাংবাদিক
  • #