কবি হেলাল হাফিজ (জন্ম : ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮-মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি ও সাংবাদিক। তিনি কবিতা লিখে বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এক সময় বাংলাদেশের কবিতাপ্রেমী পাঠকের মুখে মুখে তার কবিতা উচ্চারিত হত। কবি হেলাল হাফিজের পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলা। তাঁর পিতার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার। মাতার কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই বছর হেলাল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সেদিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি নির্লেন্দু গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দু’জনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।
প্রথম বই প্রকাশের সতেরো বছর আগেই হেলাল হাফিজ কবি খেতাপ পেয়ে যান-তাঁর কবিতা নিষিদ্ধ ‘সম্পাদকীয়’ লেখার জন্য। এ সময় কবিতাটি ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ওই কবিতার প্রথম দুইটি লাইন- ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,’ রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয় এবং এখনো পর্যন্ত এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত রাজনৈতিক স্লোগান এটি।
কবি হেলাল হাফিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দীর্ঘ সময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়ে ছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। উদ্দেশ্য পাঠক নতুন কিছু দেওয়া। কারণ, কবিতাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। হেলাল হাফিজ কবিতার মানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাই বছর বছর গ্রন্থ প্রকাশের উচ্ছ্বাস তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল না। আড়াই দশক পরে তিনি পাঠকদের জন্য লেখেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’ (২০১২), তৃতীয় এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে অমর একুশে বইমেলায়।
হেলাল হাফিজ এক নির্মোহ কবির নাম। কবিতা ছিল তাঁর কাছে আনন্দ-বেদনা যাপনের মাধ্যম। কবিতাকে তিনি কখনো উপার্জন অথবা খ্যাতির হাতিয়ার করে তোলেন নি। তাই পুরস্কারের প্রতি তার ছিল বরাবরই বিতৃষ্ণা। তারপরও বিভিন্ন সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন কবিকে বিভিন্ন পুরস্কার, সম্মাননা দিয়ে নিজেদের সম্মানিত করেছেন। এসবের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদ্যাপন কমিটি কর্তৃক ‘কবি সংবর্ধনা’ (১৯৮৫), ‘যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার’ (১৯৮৬), ‘আবুল মুনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ কর্তৃক ‘কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননা’ এবং ‘বাসাসপ কাব্যরত্ন’ (২০১৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় কবির প্রতিভার স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়। পরাধীনতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তারুণ্যকে মিছিলে এবং যুদ্ধে যেতে কবি আহ্বান জানিয়েছিলেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়কালে। কবি কী তবে মুক্তিযুদ্ধের আভাস আগেই পেয়েছিলেন। কারণ, কবিরা ত্রিকালদর্শী হয়ে থাকেন। তাছাড়া কবিগণ জানেন আত্মত্যাগের বিনিময়েই অর্জন করা যায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। তাই তারুণ্যকে কবি স্বাগত জানিয়েছেন। কবির ভাষায়-
যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।
এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
কালজয়ী কবিতার এই পঙক্তি দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। পরবর্তীতে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন- দাবী আদায়ের স্লোগান হিসেবে কবিতাটি গণমানুষের মনে তুমুল সাড়া জাগায়। কবি হেলাল হাফিজের জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬)। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিভাষা আর মানুষের হৃদয়ে সঞ্চিত আবেগের মিশেলে রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যেন হয়ে উঠেছিল গণমানুষের প্রেম ও দ্রোহের শিল্প প্রতিভাষ। তাই গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তুমুল জনপ্রিয় পায় এবং পাঠক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।গ্রন্থটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ থাকায় ১৯৮৬ সালে এখন পর্যন্ত বইটির বৈধ মুদ্রণ হয়েছে ৩৩ বারের বেশি। রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে হেলাল হাফিজের কবিতার পঙতি যেমন ব্যবহৃত হয়েছে-তেমনি আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও পারিবারিক টানাপোড়নে প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের খোঁজ-খবর করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের পঙ্ক্তি।
কবি হেলাল হাফিজ নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কবিতাটি ওই সময় কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার সাহস পায়নি। কিন্তু কবিতার প্রথম দুটি লাইন আহমদ ছফা এবং কবি হুমায়ুন কবির ১৯৬৯ সালে এক রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়াল লিখন করে দিয়েছিলেন।’ কবি শামীম আজাদ বন্ধুপ্রতিম এবং সমসাময়িক সাহিত্যিক হেলাল হাফিজকে ‘বিরল-প্রজ’ কবি আখ্যা দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘উনি কম লিখেছেন; কিন্তু প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন। কবিতা ছিল ছোট, কিন্তু ব্যাপক ভাব প্রকাশ করতো সেগুলো।’ লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে-বিদ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে যান। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন-
ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে?
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্তঋণে স্বদেশ হলো, তোমার দিকে চোখ ছিল না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’
কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে। ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় দেশ স্বাধীনের কথা বলেছেন। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস বয়ে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মাধ্যমে পাওয়া যায় দীর্ঘ পরাধীনতা থেকে মুক্তি, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড এবং একটি পতাকা। যা জাতির বীরত্ব ও সার্বভৌমত্বের পরিচয় বহন করে। কবি লিখেছেন-
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–‘পেয়েছি, পেয়েছি’।
‘ফেরিঅলা’ কবিতায় হরেক রকম কষ্টের কথা বলেছেন। একজন ফেরিঅলা যাপিত জীবনের নানা রকম কষ্ট বিক্রি করতে চান। জগৎ সংসারে কষ্টের নানা প্রকারভেদ রয়েছে।প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট, অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট, ভুল রমণী ভালোবাসার, ভুল নেতাদের জনসভার হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে। আরও বিভিন্ন প্রকার কষ্টের কথা কবি বলেছেন। কেউ কষ্টের ভার নিতে চাইলে কবি অনায়াতে তা দিতে পারেন। কবি বলেছেন-
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচাহলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
‘ইচ্ছে ছিলো’ নিটল প্রেমের এক রোমান্টিক কবিতা। এ কবিতায় কবি তাঁর মানস প্রতিমাকে সাজাতে চান নিজস্ব ঢংয়ে। বাংলার ষড়ঋতুর সৌন্দর্য এনে ঢেলে দেবেন প্রিয়ার শরীরে। প্রয়োজনে নিয়োগ করা হবে সুদক্ষ মেকাপম্যান। তাঁর প্রিয়াকে অনিন্দ্য হতেই হবে। কবির ইচ্ছে ছিলো প্রেমিকাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবেন। প্রেম দিয়ে বাজাবেন বিশ্বভুবন। কবি লিখেছেন-
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপুণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
‘নেত্রকোনা’ কবিতায় কবি যেন ফিরে তাকিয়ে দেখছেন ফেলে আসা অতীতপুরে। আবহমান বাংলার চির-সবুজ গ্রাম; বাল্যস্মৃতিতে ফিরে গেছেন কবি। নাগরিক করপোরেট জীবন মানুষকে অসাড় করে দেয়। ভালোবাসা, মায়া-মমতাহীন ইট, পাথরের শহর এক সময় বিষণ্ন লাগে। ইচ্ছে করে গ্রামে ফিরতে। যেখানে বাড়ির প্রাঙ্গণে নিষ্পলক কেউ একজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কেউ ট্রেনের হুইসেলের শব্দে তোলপাড় করে ওঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। অথচ জীবনের পাশাপাশি ওতোপ্রোতভাবে থাকে অদ্ভুত মরণ। কবির ভাষায়-
কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?
কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?
তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল।
মগড়ার ক্ষীণ কলরোল
অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,
তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,
যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে
জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।
‘প্রস্থান’ কবিতায় কবি তাঁর মানস প্রিয়ার কাছে পত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন। কারণ, প্রিয়জনের চিন্তা সব সময় মনকে ব্যথাতুর করে রাখে। যেখানে একটা চিঠি পাওয়া মানে মনের প্রশান্তি। একটা সময় ছিল-যখন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান বাহন ছিল চিঠিপত্র। দূরে অবস্থানকারী আপন জনেরা চিঠির মাধ্যমে খবরা-খবর আদান-প্রদান করতেন। কবি তাই চিঠিকেই প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। প্রিয়জনকে বার বার অনুরোধ করেছেন পত্র দিতে। কবি লিখেছেন-
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালি তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।
হেলাল হাফিজ সেই দুর্লক্ষ, দুর্লভ কবিদের একজন, যিনি নিতান্ত স্বল্প সৃষ্টি-সম্ভার সত্ত্বেও জয় করেছেন তুঙ্গস্পর্শী জনমানস। সমান্তরালে শিল্প-সিদ্ধিতেও যা পরিপ্লুত। তাঁর কবিতার বিষয় ও প্রকরণ যুগপৎ মেলবন্ধনে সার্থক, কালোত্তীর্ণ। স্বল্প সৃজনেও তিনি বরাবরই প্রাসঙ্গিক এবং প্রোজ্জ্বল। হেলাল হাফিজের কবিতার প্রাণশক্তি বস্তুত ব্যক্তিক মনোলোকের নিগূঢ় অন্তর্বীক্ষণে। আবার ব্যষ্টির অনুভব, চারিত্র, সংক্ষোভ-দ্রোহও তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র। নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না কিংবা ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’- জনশ্রুতি বা প্রবাদবাক্যে রূপান্তরিত এরকম পঙক্তিসমূহ কাল ছাপিয়ে কালান্তরের দরজায় কড়া নাড়ে। কবি হেলাল হাফিজ বেঁচে থাকবেন স্বীয় কর্মের মাধ্যমে। কবির মহাপ্রয়াণে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।