উপ-সচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ করা বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুপারিশ করবে। এ ব্যাপারে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)।
উপ-সচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিত বলেও মনে করে সংগঠনটি। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি এ আপত্তির কথা জানায়। একই সঙ্গে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের উল্লিখিত সুপারিশের বিরোধিতা করছেন। এ ধরনের খবরে প্রশাসন ক্যাডারের সব স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় কমিশনপ্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী উল্লিখিত এ সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করবে বলে জানান। অবশ্য সুপারিশ রাখা না রাখার বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি।
বৈঠকের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে সচিব ড. আনোয়ার উল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিষয়টি গণমাধ্যমে জেনেছি। লিখিত কোনো কাগজপত্র পাইনি। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া এ ধরনের প্রস্তাব করা ঠিক হবে না। সব অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি মতামত জরিপ করে তারপর সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে যদি সুপারিশ করা হয়, তাহলে বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। বিএএসএ একতরফা এ ধরনের সুপারিশের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন থেকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় কমিশন প্রধানের দেওয়া বক্তব্যের প্রতি বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। কমিশন প্রধান সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য বিদ্যমান ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করার সুপারিশের বিষয় অবহিত করেছেন। একটি জনমুখী, দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং যুগোপযোগী জনপ্রশাসন বিনির্মাণে প্রজাতন্ত্রের সর্বনিুতম বেতন গ্রেডের কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বেতন গ্রেডের কর্মকর্তা পর্যন্ত বিবেচনা করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে সমন্বিত সুপারিশ প্রণয়ন করাই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া আবশ্যক বলে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
উপসচিব পদোন্নতি প্রত্যাশী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতামত, জরিপ, সমীক্ষা সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি বলে জানা যায়। ফলে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মাঠ প্রশাসনসহ সব স্তরে কর্মরত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কমিশন প্রধানের এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
এতে বলা হয়, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তারা যখন অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনামতে আইনশৃঙ্খলাসহ স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে এ ধরনের একটি বক্তব্য আন্তঃসার্ভিস দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে পারে এবং সংস্কার উদ্যোগসহ জনপ্রশাসনকে দুর্বল করে দিতে পারে বলে অ্যাসোসিয়েশন আশঙ্কা ব্যক্ত করছে। কমিশনের লিখিত রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিলের আগেই আকস্মিকভাবে এ ধরনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হলো এবং তা কোনো মহলের ইন্ধনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে সব সময়েই প্রশাসন ক্যাডার/সার্ভিসের লোকেরাই উপ-সচিব/যুগ্মসচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে কাজ করে আসছেন। কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল মানুষকে এই বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে যে, এই পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার প্রিভিলিজ হিসাবে পান যেটি রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতার প্রতিফলন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, পৃথিবীর সব সময়ে সব স্থানে রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বর্তমান প্রশাসন ক্যাডারের অনুরূপ একদল মানুষ নিয়োজিত ছিল। রাষ্ট্র যাতে জনতার স্বার্থ সংরক্ষণ করে সেই উদ্দেশ্য ম্যাক্স ওয়েবার ও উড্রো উইলসন মেধাভিত্তিক, রাজনীতিবিদ থেকে আলাদা, আইনকানুনকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা একদল মানুষের সমন্বয়ে আমলাতন্ত্রের ধারণার প্রচলন করেন। উপমহাদেশে আইসিএস, পাকিস্তান আমলে সিএসপি ও বাংলাদেশের বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার মেধাভিত্তিক সেই আমলাতন্ত্রের মূল ধারা। এ ধারার ব্যত্যয় ঘটানোর অপচেষ্টা না করে দক্ষ আমলাতন্ত্র তৈরিতে সংস্কারের সুপারিশ বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সাদরে সমর্থন করে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে রাষ্ট্রের কল্যাণের স্বার্থে মনে করি যে, চারটি কারণে উপসচিব/যুগ্মসচিব/অতিরিক্ত সচিব/সচিব পদে শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন হওয়া উচিত। এতে বলা হয়, আমরা জুলাই-বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম একটি যুগোপযোগী, নিরপেক্ষ এবং প্রফেশনাল সিভিল প্রশাসন বিনির্মাণে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারকে পৃথক করে পূর্বের ন্যায় সব পদগুলো অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। একই সঙ্গে, প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য ক্যাডার/নন-ক্যাডার সব সার্ভিসকে স্ব-স্ব কাজের ধরন বিবেচনা করে স্বীয় সার্ভিসে পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিসহ যথাযথ ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ/বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অধিকতর বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে যুগোপযোগী কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আরও বলছে, জনপ্রশাসন সংস্কার বর্তমান সরকারের বিবেচনাধীন কার্যক্রমগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে বিপুল আকাক্সক্ষা রয়েছে। সুতরাং তড়িঘড়ি করে প্রতিবেদন দাখিলের পরিবর্তে পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে জনমুখী, সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য কমিশনের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হলো। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সব সদস্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে আহ্বান জানালে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এ কাজে কমিশনকে যে কোনো অবস্থায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। সদস্যদের শ্রমসাধ্য কাজের মাধ্যমে একটি জনবান্ধব সংস্কার প্রস্তাব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারের কাজকে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে প্রয়োগযোগ্য হবে মর্মে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিশ্বাস করে।