বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামের শেষ চিঠি

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ২ মাস আগে

প্রিয় বাংলাদেশ
কেমন আছো গো মা? জানি তুমি ভাল নেই, যেমন ভাল ছিলে না একাত্তরে। মনে পড়ে সেই দিনগুলো। হিংস্র, কুটিল শত্রুরা হত্যার নেশায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তোমার পথে, প্রান্তরে, লোকালয়ে। মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র তাদের হাতে। ঘরে-বাইরে পথে-ঘাটে শুধু লাশ। পচে-গলে শকুন আর শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হয়েছে তাদের মৃতদেহ। তোমার শান্ত, সজল নদীর জলে স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে লাশের মিছিল। তোমার কন্যারা চরম লাঞ্ছনা ভোগ করছে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে, বাংকারে, ফক্সহোলে। ওরা জয় বাংলার মানুষদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওদের সংহার মূর্তি দেখলে ভয় হয়। ওরা নিঃশব্দে হত্যলীলা সাঙ্গ করে।

মাগো তুমি তো সর্বংসহা, কী করে এ অপমান সহ্য করেছ ? তোমার তিরিশ লক্ষ সন্তান প্রাণ হারাল, তোমার চার লক্ষ মালতী, সালেহা, জুলেখা, শর্বরী চরম লাঞ্ছনায় রক্তাক্ত হয়ে লজ্জার মুখ লুকাল। সেদিন বুকে বারুদ নিয়ে ঘর ছেড়েছিলাম যুদ্ধে যাব বলে।

ফিরেছিলাম রাইফেল, স্টেনগান আর গ্রেনেড হাতে। উন্মত্ত ক্রোধে ট্রিগার টিপে ঝাঁজরা করে দিয়েছি হিংস্র, খুনি শত্রুর বুক। যুদ্ধের মাঠ থেকে শহীদ সহযোদ্ধার লাশটিও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। ওরা মিশে গেছে তোমার বিল, বাত্তড়, ঝিলে, জঙ্গলে। জানি ওরা তোমার কোমল মাটিতে শান্তির চির-ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। আমি বেঁচে গেছি। স্বাধীন দেশে, লাল-সবুজের ছায়ায় মিশে গেছি জীবনের কোলাহলে। আনন্দ বেদনায় পাড়ি দিয়েছি এক জীবনের ব্যাপ্তি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামের শেষ চিঠি

কিন্তু আজ জীবনের সায়াহ্নে, এসে এ কী দুর্যোগ দেখতে হল বলো তো? আজ আবার একান্তর ফিরিয়ে এনেছে একদল কুচক্রীমহল। আজ আবার জয় বাংলার মানুষ খুঁজে হত্যা, জেল, নির্যাতন করছে, এরা কারা? কারা আমার মহান স্বাধীনতা ও সংবিধান কলঙ্কিত করছে? নিষিদ্ধ করছে তোমার লালন, হাসন, বাউল, মারফতি । কারা আগুন দিচ্ছে মন্দিরে-মাজারে? শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ অপবিত্র করছে। বৃদ্ধ অশক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জুতার মালা পরিয়ে অপমান করছে হিংস্র আক্রোশে।
নিভিয়ে দিয়েছে শিখা অনির্বাণ, পুড়িয়ে দিয়েছে সব যাদুঘর, নথিপত্র, স্মৃতিময় ৩২ নম্বরের ধানমন্ডি। নিশ্চিহ্ন করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল স্মৃতি ভাস্কর্য। বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি ভেঙে তাতে আগুন দিয়েছে। ওরা তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আবার সেই একান্তরে। মা-বোনের ধর্ষকদের সাথে মিত্রতা করছে এই দখলদার ঘাতকেরা। তোমায় এই আপমান আর সইতে পারছি না। তোমার জন‍্য একাত্তরে অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখেছিলাম। আর আজ? আজ আমি জরাগ্রস্ত,  জীর্ণ, স্বাস্থ্যহীন। তুমি তোমার নতুন প্রজন্মকে ডাক পাঠাও।

ওরা আবার তোমাকে শত্রুমুক্ত করবে। আমি বড় ক্লান্ত গো মা। এবার আমাকে ঘুমাতে দাও। আমি জানি অনাগত মুক্তিযোদ্ধারা একদিন বিজয়ীর বেশে আমাদের সমাধির পাশে এসে দাঁড়াবে। সেদিন সকল সন্তাপের অবসান হবে। তোমার মঙ্গল কামনায়-

তোমার দেশান্তরী সন্তান
মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম
২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, নিউইয়র্ক
  • তাজুল ইমাম
  • বীর মুক্তিযোদ্ধা
  • #