বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী ডায়ালাইসিসের উপর নির্ভরশীল হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আরো ২৪ থেকে ৩০ হাজার রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে সাময়িক ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। এই রোগ আমাদের দেশের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। পক্ষান্তরে, সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে দেশের কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এই মন্তব্য করেছেন।
প্রতিবছর ১৩ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস পালিত হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আপনার কিডনি কি ভালো আছে’। এবারের প্রতিপাদ্যের মধ্যে কিডনির সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। সে কারণে প্রতিপাদ্যের আলোকে ‘কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। দেশের অন্যতম কিডনিবিষয়ক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাম্পস এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। তিনি তার মূল প্রবন্ধে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কিডনি রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণ গুলোর মধ্যে একটি। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো অসংক্রামক রোগের কারণে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার রোগীদের চেয়ে প্রায় বিশ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭ম স্থানে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে ৫ম স্থান। আবার উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।
কিডনি রোগের সাধারণ কারণ গুলো হল- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যাথানাশক ঔষধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও পাথুরে রোগী। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবো যে, প্রায় সবগুলো কারণই আমাদের অস্বাস্থ্যকর জীবন ধারার সাথে জড়িত, একটু সচেতন হলে প্রতিরোধ যোগ্য। তাছাড়া যারা ঝুঁকিতে আছেন যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশী, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী, যারা তীব্র মাত্রার ব্যাথার ঔষধ খেয়েছেন, যাদের পূর্বে কোন কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের বছরে অন্তত ২ বার প্রস্রাব ও রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেয়া উচিৎ। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ সনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ডা. সামাদ বলেন, কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তাই ক্যাম্পস এর স্লোগান ‘কিডনি রোগ জীবননাশা-প্রতিরোধই বাঁচার আশা’ ঘরে ঘরে পৌছে দিতে চাই। অর্থাৎ কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত করে চিকিৎসার মাধ্যমে মরণব্যাধি কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা।
বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, কিডনি রোগীর সংখা এখন প্রায় ৪ কোটি, প্রধানত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এর কারনে তা দ্রুত বাড়ছে এবং ডায়ালাইসিস এর সুযোগ ৬৫ শতাংশ ই ঢাকাতে কেন্দ্রিভূত। তিনি বলেন, সরকার দ্রুত ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায় ডায়ালাইসিস এর সুযোগ সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস খুব ব্যায়বহুল কারন তার ফ্লুয়িড আমদানি করতে হয় তবে ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমাতে পারলে সুবিধা হয়, এতে ডায়ালাইসিস এর সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।
বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশিদ বলেন, ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের হার কমাতে না পারলে কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হবে। অসছেতনতাই মূল কারন, আমরা জানি কিন্তু মানি না, ঝুকি জেনেও কেউ টেস্ট করাতে জাই না অথচ প্রথম এবং দিত্বিয় ধাপে ধরা পরলে কিডনি রোগ নিরাময় করা সম্ভব যা ৩য় বা পরের ধাপে গেলে একেবারেই সুস্থ করা যায়ে না। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলেতে কিডনি টেস্ট এবং রেফারাল সিস্টেম চালু করতে পারলে ভাল ফল পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি এর লাইন ডাইরেক্টর ডা. সৈয়েদ জাকির হোসেন বলেন, অসচেতনাতাই বড় বাধা কিডনি রোগ নিয়ন্ত্রণে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এর কারনে তা দ্রুত বাড়ছে, এই দুটি রোগের ঔষধ পাওয়া সহজ করতে হবে এবং দাম সীমার মধ্যে রাখতে হবে, এতে ফল পাওয়া যাবে কারন নিয়মিত ঔষধ খেলে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়ে।
তিনি বলেন, ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেই কিডনি রোগের প্রাথমিক প্রতিরোধ সম্ভব। তাছারা মানুষের খাদ্দ্যাভাস বড় কারন, সুষম খাবারের প্রতি অভ্যাস তৈরি হলে আর শারীরিক পরিশ্রম করলে কিডনি রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা অনেক সহজ।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর প্রধান নির্বাচক, ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেন ক্যাম্পস এর গৃহীত কর্মসূচী গুলো থেকে সাধারন মানুষ খুব উপকৃত হয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে ক্যাম্পস এর পক্ষে দুই দশকের বেশী সময় ধরে নিজ উদ্যোগ ও অর্থায়নে সব কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন, তাই সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থা সমূহ ক্যাম্পস এর উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে এবং চলমান রাখতে সহযোগীতার হাত বাডিয়ে দেয়া উচিত।
তিনি বলেন একটি পরিবারের একজন সদস্য কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে পুরো পরিবার আর্থিক ভাবে বিপর্যস্থ হয়ে যায়। সব কিছুর উর্ধ্বে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধ কে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, মানুষকে এমন ভাবে বোঝাতে হবে যে, যে কোন মূল্যে এ রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে অন্যথায় বিপদের আর ভোগানতির শেষ থাকবে না।
ক্যাম্পস-এর নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন বলেন, ক্যাম্পস কিডনি রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সচেতনতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে। আমরা যদি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলি তা হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই সরকারী ও বেসরকারী পর্যায় থেকে যদি সকলে এগিয়ে আসেন তা হলে এই রোগ নিরাময় করা অনেকটাই সহজ হবে।