চিকিৎসাবিষয়ক ব্যয়বহুলতার কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে ক্যানসারের মতো রোগের কথা। অথচ, কী আশ্চর্য- যুক্তরাষ্ট্রের কেক স্কুল অব মেডিসিনের সিনিয়র পোডিয়াট্রিক সার্জন ড. দাউদ আর্মস্ট্রং-এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষতরোগ সংক্রমণের চিকিৎসা ব্যয় স্তন, কোলোরেক্টাল, ফুসফুস, প্রস্টেট ক্যানসার কিংবা লিউকেমিয়ার চিকিৎসার চেয়েও বেশি হতে পারে। আরো দুঃখজনক, যেখানে ক্যানসার আক্রান্তরা সচরাচর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করেন না, ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত রোগীরা প্রাথমিক সমস্যা অবহেলা করার ফলশ্রুতিতে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত চিকিৎসার ব্যয় দেশভেদে ভিন্ন। ‘অ্যাটলাস অব দ্য ডায়াবেটিক ফুট’-এর তথ্য অনুযায়ী, একটি সংক্রমিত পায়ের সম্পূর্ণ নিরাময়ে খরচ তানজানিয়ায় যেখানে গড়ে ১০২ মার্কিন ডলার, যুক্তরাষ্ট্রে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৯৫৯ ডলারে। যদিও এই পরিসংখ্যান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে তুলে ধরে, বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গড় আয়ের ব্যক্তির জন্য এটি প্রায় ছয় দিনের আয়ের সমান— যা এক বিরাট চাপ। অন্যদিকে, নিম্ন-আয়ের দেশে তুলনামূলক কম খরচ হলেও, তা ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য সর্বনাশা আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন, ভারতে ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত আলসারের চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ১,২০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ রুপি পর্যন্ত পৌঁছে, যার মধ্যে হাসপাতালের চার্জ, চিকিৎসার মান ও রোগের জটিলতা অনুযায়ী পরিবর্তন দেখা যায়।
ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত চিকিৎসার ব্যয় broadly দু’টি ভাগে বিভক্ত- এক. সরাসরি খরচ : হাসপাতাল ভর্তির চার্জ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অ্যান্টিবায়োটিক, ড্রেসিং, সার্জারি, অ্যামপুটেশন, রি-ভাসকিউলারাইজেশন, অস্থি-যন্ত্র, এবং বহির্বিভাগীয় পরামর্শ ইত্যাদি এতে অন্তর্ভুক্ত।
সংক্রমণ থাকলে গড়ে সরাসরি খরচ প্রায় ৮,১১৩ রুপি। সংক্রমণের পাশাপাশি পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ (PVD) থাকলে খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, প্রায় ১৬,৪১৪ রুপিতে পৌঁছায়। শুধুমাত্র হাসপাতালে থাকার (অপারেশন ও পরীক্ষার বাইরে) খরচ ৩,৭০৩ থেকে ৬,৭৮৭ রুপির মধ্যে ওঠানামা করে।
দুই. পরোক্ষ খরচ : এই অংশটি আরও জটিল এবং বোঝা কঠিন। এর মধ্যে রয়েছে- কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির কারণে আয়ের ক্ষতি, সময়ের আগেই অবসর গ্রহণ, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের ব্যয়, স্থায়ী অক্ষমতার জন্য সহায়তা প্রয়োজন এবং রোগী ও পরিবারের মানসিক চাপ ও দুর্ভোগ। PVD-সহ সংক্রমণ থাকলে সরাসরি ও পরোক্ষ ব্যয় মিলিয়ে মোট খরচ প্রায় ১৬,৮৫৩ রুপি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত শুধু আর্থিক ব্যয় নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক সংকটও। রোগীরা প্রায়শই- কর্মজীবন থেকে আগেভাগে সরে আসতে বাধ্য হন, পরিবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত বা অঙ্গহানির কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হন, মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ ও হতাশায় ভোগেন এবং গ্রামাঞ্চলে পুনর্বাসন সেবার অভাবে অবহেলিত থাকেন। এই সামাজিক ক্ষতিগুলো নির্ণয় করা কঠিন হলেও, এগুলোর প্রভাব পুরো সমাজ ব্যবস্থায় ঢেউ তুলে দেয়, বাড়ায় স্বাস্থ্যখাত ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর চাপ।
ড. আর্মস্ট্রং একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন রোগীদের অবহেলা। যেখানে ক্যানসার রোগীরা স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ছুটে যান, সেখানে ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত রোগে আক্রান্তরা ছোটখাটো আলসার, ফোলা বা ব্যথার মতো লক্ষণ উপেক্ষা করেন। এর ফল ভয়াবহ হতে পারে। এক্ষেত্রে জরুরি- জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রাথমিক সতর্কতার শিক্ষা প্রদান, সহজলভ্য প্রতিরোধমূলক পোডিয়াট্রিক সেবা, কমিউনিটি-ভিত্তিক পায়ের স্বাস্থ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ এবং প্রতিরোধ ও সচেতনতার মাধ্যমে না এগোলে অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতি শুধু বাড়তেই থাকবে।
ডায়াবেটিসে পায়ে ক্ষত কেবল একটি চিকিৎসাজনিত সমস্যা নয়, এটি এক নীরব অর্থনৈতিক ও সামাজিক মহামারি। এর প্রতিরোধে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা, সক্রিয় সরকারি নীতি, এবং সমাজের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি। নইলে, আমরা শুধু অর্থের ক্ষয়ই দেখব না, বরং হারাব আরও অগণিত জীবন ও মানবিক সম্ভাবনা।
লেখক : সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, ফরিদপুর ডায়বেটিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপতাল এবং বর্তমানে ইবনে সিনা হাসপাতালে (যশোর) কর্মরত