গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। আমার গ্রামের বাড়ির কাছেই লালনের আখড়া- ফুলহরি চলে কীর্তনীয়াদের কৃষ্ণবন্দনা। সেখানেও আমার রীতিমত যাতায়াত ছিল। বাবার মুখে শুনেছি লালন, পাঞ্জু, পাগলা কানাই ও জারিয়াল মকবুল জোয়ার্দারের নাম। সেই ছোটবেলা থেকেই এই গ্রামীণ লোককবি বা গীতিকারদের জীবনাচার এবং তাদের সারল্যতা আমাকে মুগ্ধ করে চলেছে। বড়বেলা নানা বিষয়াদি পড়ার ফলে নিজের জায়গা থেকেও বুঝতে শিখেছি তারাই একমাত্র আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সত্যিকার অর্থে তারাই আমাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসে এবং নিজের শিকড়ের কাছাকাছি থাকেন।
এসব মানুষদের কোন লোভ-লালসা থাকে না। নিজের আপন মনে তারা গান কবিতা রচনা করে থাকেন এবং স্থানীয় শিল্পীরা নিজেদের কণ্ঠে ধারণ করে গেয়ে বেড়ান নানা অনুষ্ঠান কিংবা কোন গানের আসরে। এতেই যেন তাদের তৃপ্তি। গানের মানুষগুলোকে সবাই চিনলেও যারা গানকে সৃষ্টি করে থাকেন তারা থেকে যান সবার চোখের আড়ালে। কেউ এই গীতিকারকে চেনেনও না। শুধু চেনেন যিনি গানটা গেয়েছেন তাকে। আবার অনেকে গান পরিবেশনের সময় যে গানটি লিখেছেন তার নামটাও উচ্চারণ করেন না এটা মূলত একজন শিল্পীর দীনতা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। যার যেটুকু সম্মান তার ততটুকু সম্মান জানালে আমাদের কি এমন ক্ষতি হতে পারে বরং যে সম্মান দিল প্রকৃতপক্ষে তিনিই তো সম্মানিত হলেন।
এই প্রকৃত মাটির মানুষেরা মাটির কাছাকাছি থাকেন এবং কোন খ্যাতি কিংবা প্রাপ্তিলাভের আশে শিল্পচর্চা করেন না। তারা ধ্যানের সাথে এবং নিজের একান্ততা দিয়েই এই সাধনায় লিপ্ত থাকেন। এমনই একজন শিল্পসাধক কবি ও গীতিকার আহসান উল্লাহ মৃধা। যার গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঝিনাইদহ জেলার মানুষের মুখে মুখে। ছোটবেলা থেকে অনেকে তার গান শুনেছেন কিন্তু কেউ বলতে পারেন না এই গানগুলোর সৃষ্টিকারী আহসান উল্লাহ মৃধা। অনেকের কাছে আহসান উল্লাহ মৃধা’র সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ তেমন তথ্য দিতে পারেন না। অথচ তার হাত ধরে বের হয়েছে অগণিত শিল্পী। কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও আমার অনুসন্ধান চলবে তথ্য সন্ধানে।
কৌতুক অভিনেতা হূমায়ুন কবিরী টুকু একজন ত্যাগী শিল্পী। যিনি এক সময় মঞ্চনাটক ও পথনাট করেছেন। যার জন্য তাদের অনেক অত্যাচার এবং লাঞ্চণা ও বঞ্চণার শিকার হতে হয়েছে। যাক সে সব কথা একদিন টুকু ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিতে দিতে আহসান উল্লাহ মৃধা স্যারের কথা উঠল। কিন্তু তিনি আবসোস করে বললেন- দেখেন রাখাল ভাই। এই মানুষটা কত গান লিখেছেন কত হাস্য কৌতুক লিখেছেন অথচ কেউ তার নিয়ে কোন কাজ করল না বা করতে চান না। তার গানও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন জায়গা। একত্রও করা হয়নি কখনো। এই অভিযোগ কিংবা আক্ষেপ আমাকে ব্যথিত করেছিল। একজন সজ্জন শিল্পীর জ্ঞানসাধনা বা তার লিখিত কর্ম কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে সেটা তো হতে পারে না।
সেদিনই টুকু ভাই আহসান আলী মৃধার বড়ছেলে পলাশ মৃধার সাথে আমার ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন। কথা হল আমাদের। পরে দিন দেখা হওয়ার কথা থাকলেও আমাদের দেখা হলনি। আমি পরের দিন যথারীতি আমার কর্মক্ষেত্র পাবনায় চলে আসি। পরের সপ্তাহয়ে বাড়িতে এসে আবার ফোন করি পলাশ ভাইকে। আমাদের কথা হল এবং সে আমার জন্য ভাটই বাজারে ইলিয়াসের দোকানে বসে থাকবেন বলে জানালেন। এই দোকানটা ঠিক স্যার যে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তার সামনে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মহাসড়কের পাশে। আমাদের দেখা হল; অনেক কথা হল আহসান আলী মৃধাকে নিয়ে। অনেকের নামও জানতে পারলাম পলাশের কাছ থেকে যারা একসময় মানে এখনও আহসান উল্লাহ মৃধা’র গান করেন।
যারা গান করেছেন বা করছেন তাদের মধ্যে- মাহফুজ মিঠু, মজিবর, হুমায়ুন কবিরী টুকু, প্রফেসর বিটুল, ফিরোজ, অনিল হাজারিকা, সোহেল রিজভী, গীতিকার নির্জল ও দেবু চক্রবর্তী। একসাথে বসেই পলাশ মৃধা সবার কাছে ফোন দিলেও মৃধা স্যারের গানের হদিস কেউ দিতে পারলেন না। গীতিকার নির্জল শুধু বললেন তার কাছে কিছু গান আছে স্যারে তবে তা সম্পূর্ণ না। তবে তিনি বললেন প্রফেসর বিটুল স্যারের কাছে সব আছে। কিন্তু প্রফেসর বিটুলের কাছে ফোন দিলে তিনিও জানান তার কাছে যা ছিল সব তিনি শিল্পকলাতে জমা দিয়েছিলেন। আর নিজের কাছে যা ছিল তাও এখন নাই। এভাবেই আমাদের রিক্ত হাতে ফিরবার পালা। কিন্তু না আমরা এভাবে সব বেনোজলে ভসে দিতে পারি না। আমি আবার ছুটলাম কৌতুক অভিনেতা টুকু ভাইয়ের কাছেÑ তখন তিনি আমাকে একটা গানের সন্ধান দিলেন-গানটি সকলের অবগত হওয়ার জন্য নিম্নে দেওয়া হল :
হুলো বিড়াল বসেছে ধ্যানে
ওরে লাফ দিয়ে যে ধরবে ইঁদুর
কুলায় না আর গতরে
হুলো বিড়াল বসেছে ধ্যানে।।
যখন ছিল যৌবনকাল
ভবে করেছো কত তাল
পরের হাড়ির গন্ধ শুঁকে
কাটাইছো কাল।
কত হামলা দিয়ে গামলী নিয়ে
কত সিকে ছিঁড়েছো
হুলো বিড়াল বসেছে ধ্যানে।।
উজান বিলে হয় গো বিদায়
ও যখন ভাটি স্রোতি বয়
অবশেষে সাধু বেশে
কাল কাটাতে চাই বিড়াল।
এই গানটা শেষ হওয়ার পরে টুকু ভাই জানালেন স্যার আছাননগরের একজন আধ্যাত্নিক পুরুষ আছালত পাগলাকে নিয়েও একটা গান লিখেছিলেন। তবে সেই গানটা আমার মনে নেই। আছে মাত্র দু লাইন- ‘প্রেমের টানে দড়া ছিঁড়ে যায়/থাকে না কোন লোক লজ্জা ভয়’…। এই আছালত পাগলের কাছে অনেকে আসত অনেক কিছুর প্রত্যাশায়। কিন্তু সে লাঠি দিয়ে তাদের প্রচুর পিটাতেন। এই পিটানি খেয়ে নাকি অনেকের রোগ ভাল হয়ে যেত- এমন লোকবিশ্বাস অনেকের মধ্যে সে সময় ছিল এবং এখনও অনেকে মনে করেন আছালত পাগলা অনেককিছু জানতেন। আছাননগর রাস্তার কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মহাসড়কের পাশেই এই সাধকের মাজারটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
স্যার ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণকে ছড়ায় ছড়ায় এবং জারির মাধ্যমে ছাত্র/ছাত্রীদের সহজীকরণ করে সৃষ্টি করেছিলেন। যা সে সময় সবার কাছেই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বর্ণমালা দিয়েও আহসান উল্লাহ মৃধা প্রচুর গান লিখেছিলেন। তবে পলাশ মৃধা অনেক তথ্য না দিতে পারলেও আমাদের কয়েকটা বর্ণমালা নিয়ে তৈরি গানের লাইন বলতে পেরেছিল সেগুলো নিম্নে দেওয়া হলÑ
এক.
ট= টসটসে টইটম্বুর টিনা/টাটকা টমেটো…
দুই.
ব= বন্ধু বাজায় বাঁশের বাঁশি /বিনা বাঁধার বাঁধনী/বুকেতে বাঁধিয়া বাসা…
তিন.
গ= গৌরী গায়ের গোবিন্দ গোসাই /গোকুলের গান গায়…
একসময় কৌতুক অভিনেতা মজিবর টুকুর হাস্যকৌতুকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিতেন আহসান উল্লাহ মৃধা। যা সারা দেশে নাম করেছিল এবং তারা সুপরিচিতি পেয়েছিলেন। মৃধা স্যার অনেক প্যারোডি গানও লিখেছিলেন যা মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। স্যার ছিলেন আধ্যাত্মিক ঘরানার মানুষ। নিজের সৃষ্টি নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকতেন। আহসান উল্লাহ মৃধার কাছে যশোরের আঞ্চলিক গানের শ্রোষ্টা যাকে বলা হয় সেই অনীল হাজারিকা এসেছেন; তার বাড়িতে থেকেছেন এবং গীতিকার মৃধার গান গেয়েছেন।
২০১৫ সালে কবি ও গীতিকার আহসান উল্লাহ মৃধাকে জেলা শিল্পকলা থেকে ‘শিল্পকলা সম্মাননা’ দেওয়া হয় লোক সংস্কৃতিতে। সেখানকার স্যুভিনিতে তার সম্পর্কে যা লিখাছিলÑ‘আহসান উল্লাহ মৃধার পিতা মরহুম জোয়াদ আলী মৃধা ও মাতা রাহেলা খাতুন। একেবারে গ্রামের ধুলি কণা মেখে এ মানুষটি সাহিত্য সংস্কৃতিতে নিয়ত অবদান রেখে চলেছেন। গান, কবিতা, ছড়া, নাটক, গল্প প্রভৃতিতে লোক সাহিত্যের অনুরাগ ঢেলে নিজেই পরিণত হয়েছেন লোকমানসে। বলা যায় তাঁর সংস্পর্শিত গণ্ডিতে অনুরাগীদের মধ্যে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তিও।
এই প্রতিভাধর ব্যক্তির জন্ম শৈলকূপার যোগীপাড়া গ্রামে ১৯৫৩ সালের ১ এপ্রিল এক কৃষক পরিবারে। সেই ছেলেবেলাতে তার দাদা ছকাতুল্য মৃধার ইচ্ছায় স্থায়ী আবাস পরিবর্তন হয়ে বাস শুরু করেন গোয়ালখালী ভগবাননগরে। শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তথা পঞ্চম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি অর্জন করেন। এরপর এসএসসিতে বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে এবং পরবর্তীতে আইএসসি ও বিএসসি পাশ করেন। ভাটই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন ২৫ বছর। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে রয়েছেÑ গণিতের প্রধান আটটি পদ্ধতি নিয়ে সহজ জারি বেঁধে জনপ্রিয় গানের সাথে আনন্দদায়ক পরিবেশনের মধ্যে শিক্ষাপ্রদান। বাংলা এবং ইংরেজি ব্যাকরণ শিক্ষাপ্রদানের ক্ষেত্রেও তিনি একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে চলেছে। সংস্কৃতি চর্চায়ও তিনি সমানভাবে ছাত্র/ছাত্রীদের উৎসাহ দিয়েছেন।
নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গড়েছেন ‘দুর্বার শিল্পী সংঘ’। যা ভাটই বাজারসহ শৈলকূপার একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে পরিগণিত। বহুমুখী প্রতিবার অধিকারী আহসান উল্লাহ মৃধা ঝিনাইদহের গর্ব। তিনি সকলের কাছে অনুপ্রেরণার হয়ে থাকবেন।’ এই মাটির সাধক ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেণ। এই সামান্য লেখায় আহসান উল্লাহ মৃধার অবদানের কথা তুলে ধরা সম্ভব না। তাঁর বর্ণাঢ্যময় জীবনের কোনো কিছুই শিল্পকলা তুলে ধরতে পারেনি। তবুও আশার কথা গ্রামীণ এই যে সংস্কৃতিকে যারা অন্তরে ধারণ করে সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন ব্যাপক অর্থে মানুষের কাছে। এই শিল্পকলার সম্মান তাদের তুলনায় সামান্য হলেও তারা যে একটু অন্যদের থেকে আলাদা তারা তা বুঝতে পারেন।
আহসান উল্লাহ মৃধাদের মতো কত হীরা-মানিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন আমাদের গ্রামীণ মাটির সন্তান হিসেবে। যারা আমাদের সংস্কৃতির একান্ত ঘরের সন্তান, তাদের খুঁজে বের করে তাদের সৃষ্টির সঠিক মূল্যায়ন করা উঠিত। তবেই হবে আমাদের সত্যিকার অর্থে সংস্কৃতিকে লালন বা ধারণ করা। হীরা-মানিকের সম্মান দেখানোর ফলে আমরা পেতে পারি ভবিষ্যতে আলোর দিশা। আর সংস্কৃতির বিকাশ তো একদিনে হয় না প্রজন্ম পরম্পরা হয়ে থাকে। আর আমাদের উত্তর প্রজন্মকে সঠিক পথের দিশা দিতে হলে বা তাদের সঠিকপথে হাটতে হলে তাদের এই হীরা-মানিকদের মূল্যায়ন একান্ত কাম্য। তা না হলে আমাদের সামনে হাজির হবে এক সংকটময় মুহূতর্; যেখানে আমাদের মুক্তির দিশা পাওয়া বড় কষ্ট।
লেখক : কবি