আন্দোলনে যুবকের মৃত্যু : মামা সেজে মামলা করতে গিয়ে উল্টো আসামি ২ ব্যক্তি

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ ঘন্টা আগে

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ‘মামলা বাণিজ্য’ নিয়ে শোরগোলের মধ্যে ঢাকায় এমন কর্মকাণ্ডে ফেঁসে গেছেন দুই ব্যক্তি।বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হাসান নামের এক তরুণ নিহতের ঘটনায় মামা সেজে তাদের একজন আদালতে মামলা করেছিলেন, আরেকজন মামলা করতে গিয়ে বিচারকের কাছে ধরা পড়েছেন। ‘জালিয়াতি’ ধরা পড়ার পর তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে পৃথক মামলা, দুটোরই তদন্তভার পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই।

নিহতের পরিবার বলছে, স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলা দায়েরের পরিকল্পনা তারা করেছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে যে হত্যা মামলা হয়ে গেছে, সে বিষয়ে তারা জানেন না।

গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিতে প্রাণ হারান ১৯ বছর বয়সী হাসান। অভাবের তাড়নায় ভোলা থেকে ঢাকায় আসা এ তরুণের লাশ দীর্ঘ ৬ মাস ধরে ঢাকা মেডিকেলে পড়ে ছিল। পরে জানতে পেয়ে পরিবার তার লাশ এলাকায় নিয়ে দাফন করে।

হাসানের বাবা দিনমজুর মনির হোসেন জানান, দুই মেয়ে আর দুই ছেলের মধ্যে হাসান ছিলেন মেজ। অভাবের সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তাকে সপ্তম শ্রেণিতেই পাঠ চুকাতে হয়। ঢাকার গুলিস্তানে তিনি ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। হাসানের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই দশম শ্রেণিতে আর ছোট বোন নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

‘আমার সামনে ঘটনা ঘটেছে, তাই মামলা করতে এসেছি’

হাসান নিহতের ঘটনায় মামা পরিচয় দিয়ে গত ২৩ মার্চ ঢাকার মহানগর হাকিম এম মিজবাহ উর রহমানের আদালতে মামলা করেন ইমরান নামের এক ব্যক্তি। মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, ওয়ারী জোনের সাবেক ডিসি ইকবাল হোসেন, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশীদ মুন্নাসহ ১৮০ জনকে আসামি করা হয়। ওইদিন বিচারক বাদীর কাছে জানতে চান, ভুক্তভোগী কে হয় তার? তখন ইমরান বলেন, ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়।’

পরিবার না এসে ইমরান কেন মামলা করতে এসেছেন, তা জানতে চান বিচারক। এ প্রশ্নের উত্তরে ইমরান বলেছিলেন, ‘আমার সামনে ঘটনা ঘটেছে। এজন্য আমি মামলা করতে এসেছি।’ পরে আদালত শুনানির ও আদেশের জন্য ৯ এপ্রিল দিন ঠিক করে। শুনানির দিন নিহতের বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বাদীকে আসতে বলা হয়। তবে পরপর দুই ধার্য তারিখে ইমরান আদালতে না যাওয়ায় মামলা খারিজের আদেশ দেন বিচারক। সেই সঙ্গে ইমরানের বিরুদ্ধে ‘মিস কেস’ দায়েরের নির্দেশ দেন।

এ বিষয়ে জানতে ইমরানের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

যোগাযোগ করা হলে ইমরানের আইনজীবী কামরুল আহসান বলেন, আমরা যারা আইনজীবী, তারা তো আর ঘটনাস্থলে যাই না। বাদী-বিবাদী যা বলেন, সেই অনুযায়ী কাজ করি। যেদিন বাদী মামলা করতে আসেন, আদালত ভিকটিমের সাথে সম্পর্ক কী, জানতে চান। তার কথা শুনে আমার ডাউট লাগে। পরে আমি তাকে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলি।

কামরুল বলেন, আদালত মামলা ফাইলের পর দুটি তারিখ রাখেন। কিন্তু ইমরান আদালতে আসেনি। পরে এসে বলে, মামলা যেন না হয়- এজন্য আসামিরা তাকে কোর্টে আসতে বাধা দিয়েছে। পরে অফ ডেটে একদিন শুনানি করি। চাপের মুখে মামলা প্রত্যাহার করাই। পরে আদালতে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিছে। মিস কেস দায়ের করেছেন।

এক প্রশ্নের উত্তরে আইনজীবী কামরুল বলেন, মে বি যাত্রাবাড়ীর কিছু লোকজনের ইন্ধনে সে মামলাটা করেছে।

ইমরানের মোবাইল বন্ধের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, হয়তো ভয়ে পালিয়েছে। এজন্য ফোন বন্ধ করে রেখেছে হয়তো।

‘এটা যে হত্যা মামলা জানতাম না’

একই আদালতে গত ২৯ এপ্রিল হাসানের মামা পরিচয়ে হত্যা মামলার আবেদন করেন রাইড শেয়ারের বাইকার ফাইজুল ইসলাম শাওন। মামলায় যাত্রাবাড়ী-৫ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য মশিউর রহমান মোল্লা সজল ও মনিরুল ইসলাম মনু, পুলিশের সাবেক দুই আইজি শহীদুল হক ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, ওয়ারী জোনের সাবেক ডিসি ইকবাল হোসেনসহ ২৩১ জনকে আসামি করা হয়।জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পেরে শাওনকে দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বিচারক মিজবাহ উর রহমান।

তখন শাওন দাবি করেন, তিনি হত্যা মামলা করতে আসেননি। আন্দোলনের সময় ৪ অগাস্ট সন্ধ্যার দিকে যাত্রী নিয়ে তিনি যাত্রাবাড়ীতে যান। সেখান থেকে স্টাফ কোয়ার্টারের রাস্তায় যাওয়ার সময় শাওন দেখেন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করছে। এর মধ্যে কেউ একজন ছুরিকাঘাত করলে গামছা দিয়ে হাত বেঁধে বাসায় ফেরেন। সেখান থেকে নতুন বাজার এলাকায় ফরাজী হাসপাতালের ২১টি সেলাই নেন। বিচারক তার চিকিৎসাপত্রে দেখেন, উত্তর যাত্রাবাড়ীর মীর টিপু সুলতানের ফার্মেসি থেকে কাটা স্থানে ৬টি সেলাই নেন শাওন।

পরে পরিবারের সদস্যের জিম্মায় আদালত শাওনকে ছেড়ে দেয়, বাতিল করা হয় তার আবেদন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধেও ‘মিস কেস’ দায়ের করা হয়, যার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে পিবিআইকে।

জানতে চাইলে শাওন বলেন, যাত্রাবাড়ীতে সানি নামের একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে বলে, আন্দোলনে আহত হলেন- জিডিও করলেন না, মামলাও করলেন না। সেই আমাকে মামলা করার পরামর্শ দেয়; আর সব ব্যবস্থা করে। আসামিদের তালিকাও করে। আমি তো জানি, আমাকে যে ছুরিকাঘাত করেছে এ অভিযোগে মামলা। এটা যে হত্যা মামলা জানতাম না।

শাওন বলেন, ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিলাম। সানি উৎসাহিত করে এ কাজটা করেছে। আর মামলাটা যে ওইভাবে ফাইলিং করছে, অবগত ছিলাম না। হাতের বিষয়ে মামলা করতে গিয়েছিলাম। মার্ডার মামলা করতে যাইনি। বলছে একটা, করেছে আরেকটা।

এ বিষয়ে শাওনের আইনজীবী অমিয় কুমার বাড়ই বলেন, প্রকৃত তথ্য গোপন করে মামলা করতে এসেছিল। আদালতে কাছে ধরা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে মিস কেস হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে এই আইনজীবী বলেন, আমি আইনজীবী মানুষ, আমার তো কোনো কিছু বলার নেই। তাকে আমার কাছে আসতে নিষেধ করেছি।

হাসানের পরিবার যা বলছে

নিহত হাসানের বাড়ি ভোলার কাচিয়া বেপারী বাড়ি গ্রামে। সেখান অবস্থানরত বাবা মনির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় মোবাইল ফোনে।

তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ, দিনমজুরি করে খাই। অসুস্থ, হার্টের রোগী। একার আয়ে সংসার আর চলছিল না। ছেলেকে ঢাকাতে পাঠাই ইনকাম করতে। সে তার বড় বোনের স্বামীর সাথে গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারে ইলেকট্রনিক্সের দোকানে কাজ করত। থাকত যাত্রাবাড়ী সুতিখালপাড়ায়। হাসানই সংসার চালাত। আন্দোলনের সময় ও ঢাকায় ছিল। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ৫ তারিখ বিকেলে গুলিতে নিহত হয়। এর আগে সকালেও আন্দোলনে ছিল। বিকালে গুলিতে মারা গেল।

মামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মনির বলেন, সাত মাস পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলে ছেলের লাশ পান তিনি। এরপর এলাকায় লাশ দাফন করেন। ছেলেকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছি। কোনো মামলা করিনি। আর যারা মামলা করতে গেছে- তাদের আমি চিনি না, জানি না। তারা আমার আত্মীয়-স্বজন না।

পরিবার থেকে মামলা করবেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হাসানের এক মামা পুলিশে চাকরি করে। তার আরও তিন মামা ঢাকা থাকেন। ঈদের সময় তারা সবাই বাড়িতে আসবেন। সবার সাথে আলাপ করে মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। তবে কোনো নিরাপরাধীর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করব না।

সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম 

  • আসামি
  • মামলা
  • মামা সেজে
  • #