আত্মহত্যার সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হল মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ততা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় যন্ত্রণার স্থায়ী অনুভূতি এবং আত্মহত্যার মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার অনড় এক বিশ্বাস। কিছু মানুষ গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ভিতর থেকে আত্মঘাতীপ্রবণ হয়ে থাকে। নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহনন করেছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। বছর দুয়েক আগে নিজের মাথায় পিস্তলের গুলি করে আত্মহনন করেছিলেন আবু মহসিন খান নামের ঢাকার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। এছাড়া বিখ্যাত মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এডগার এলান পো বিভিন্ন বঞ্চনা এবং বিষাদগ্রস্ততায় আত্মহননের মতো কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মহনন নিয়ে শিল্পী মান্না দে বলেছিলেন বর্তমান সময়ের সাথে তিনি তালমেলাতে পেরে উঠেননি। সময়ের সাথে মানুষের বিরূপ এবং নিষ্ঠুর পরিবর্তন তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে, ব্যাট-বলের এ পাশা খেলায় তিনি ততো চতুর হতে পারেনি। তাই তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
এবার আত্মহননের চিতায় যোগ হলেন আরেক মহারথি, রবীন্দ্র বরপুত্র- সাদি মহম্মদ। রবীন্দ্র আশীর্বাদপুষ্ট এ লিজেন্ডকে কোনো সামান্য ধাক্কা পরাজিত করতে পারে না। কেননা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে দেখেছেন জীবনের সুষমামণ্ডিত রূপ, এক জীবনের হারয়েছেন অসংখ্য আপনজন। এতো কঠিন ও কঠোর মৃত্যু যন্ত্রণার মাঝেও তিনি নিজে আত্মহননের পথ বেছে নেননি। তবে প্রশ্ন আসে, মনে-প্রাণে ও ধ্যানে রবীন্দ্র আদর্শিক হয়েও সাদি মহম্মদ কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? আমি বলব অপমান, অবমাননা আর বঞ্চিতের যন্ত্রণা তাকে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি একদিনে নয়, তাকে ধীরে ধীরে বিষের পিয়ালা পান করিয়েছি আমরাই। আমরা তাঁকে মৃত্যুর কণ্টকময় পথে ঠেলে দিয়েছি। আমাদের একচোখা নীতি, অসম সমাজব্যবস্থা, বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখী করেছে। এ সমস্ত বড় মাপের মানুষেরা ভীষণ অন্তর্মুখী হন, আঘাতে আঘাতে হৃদয়ের তলদেশ ক্ষয়ে গেলেও অভিমানে নিশ্চুপ থাকেন, ভেতরে পুড়ে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। আমাকে/আপনাকে আঘাত দিলে হয়তো আমরা সয়ে নিবো, অপমান করলে হয়তো প্রতি আঘাত করবো, ধাতস্ত হয়ে হয়তো সেড়ে উঠব। কিন্তু এঁরা সে জাতের নন, সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ এঁরা, বড় সুকোমল হৃদয়। আমাদের হৃদয়ের সাথে তার হৃদয়ের তুলনা চলে না। তাই যেন আমার-তোমার হৃদয়ের বাটখারা দিয়ে তাকে যেন না মাপি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করছিলেন যে কিংবদন্তি চিকিৎসক নীলরতন সরকার, তিনি কখনোই কবির অস্ত্রোপচার করানোর পক্ষে ছিলেন না। ডা. সরকার যখন স্ত্রী বিয়োগের পরে গিরিডিতে চলে যান, সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে অস্ত্রোপচার করার কথা জানিয়ে দেন। তাঁদের সবার যুক্তিতর্ক শুনে স্যার নীলরতন বললেন, ‘আপনাদের কথা সবই ঠিক যে এ অপারেশন খুবই সহজ। অনেকবার অনেক বৃদ্ধের রোগ আপনারা সারিয়েছেন, সামান্য একটা ফোঁড়া কাটার মতো ব্যাপার। সবই মানলাম কিš‘ আপনারা একটা কথা মনে রাখছেন না যে রোগী অন্য কোনো লোক নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সর্বসাধারণের মতো ওর নার্ভাস সিস্টেম নয়। সুকুমার দেহ ওর। কাজেই অন্য লোকের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। খুব ভালো করে সুরে বাঁধা একটা বাদ্যযন্ত্রের মতো। বাইরে থেকে আঘাত করতে গেলে যে ধাক্কা শরীরে লাগবে, তাতে ওর সমস্ত দেহ যন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশঙ্কা। আমার মনে হয় না এই রিস্ক নেওয়া উচিত হবে। ওষুধ দিয়েই এখন চিকিৎসা হোক না।’
সাদি মহম্মদের হৃদয় ছিলো সেই সুকুমার প্রবৃত্তির, সেতারের সূক্ষ্ম তারে বাঁধা। বাইরের এই অপ্রস্তুতের ধাক্কা তার জীবনটাকে বিকল করে দিয়েছে, তিনি এই অস্থিরতার আর দোলাচলের প্রতিকূল তরঙ্গে আর উপায় খুঁজে পাননি। অবমাননার অবাঞ্চিত জীবন তরীটি তিনি মাঝ দরিয়ায় নিজেই ডুবিয়ে দিয়েছেন! তাঁকে কে/ কারা ঠেলে দিয়েছে আত্মহননের পথে, কে দায়ী তার এ অপমৃত্যুর জন্য? আমি বলব আমরাই দায়ী, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার যাঁতাকল দায়ী, রাষ্ট্রের প্রহসন দায়ী।
কতটা কষ্ট-অভিমানে-বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা আর অবমানায় মানুষ আত্মহত্যা করে, আমরা কি জানি বা জানার চেষ্টা করেছি? তিনি আর কাউকে হত্যা করেননি, নিজেকেই সরিয়ে নিয়েছেন। জাজমেন্টাল হওয়ার আগে একটু মানবিকভাবে ভাবুন, আপনি কি কোনো ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের পাশে কখনো দাঁড়িয়েছেন? একজন সাদি মহম্মদ দেশের মানুষকে যতটুকু দিয়ে গেছেন, তার এক সহস্রাংশও আপনি/আমি কি দিতে পেরেছি?
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গ্রেশাম এর মতবাদ অনুয়ায়ীÑ ‘নিকৃষ্ট মুদ্রা বাজার হতে উৎকৃষ্ট মুদ্রাকে বিতাড়িত করে।’ আমাদের সমাজব্যবস্থাটাও তাই। নষ্টদের মাঝে গুণী মানুষের জন্ম হয় না, হলেও তাঁরা টিকে থাকেন না। গুণী মানুষ স্রষ্টার আশীর্বাদ, গুণী মানুষের সম্মান না দিলে, তাঁদের যত্ন না নিলে তাঁরা হারিয়ে যাবেই। রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার মতো- গুণীরা ধন-দৌলত চায় না, তারা চায় রাজার হাতের ফুলের মালা। আমরা এতোটা নীচ, হীন এবং ইতর যে একজন বরেণ্য গুণীর সমাদর করতে পারিনি, আমরা সম্মান দিতে পারিনি বেহেস্তের সুরের পাখিকে। সুরের পাখি তাই কোন অনুযোগ না জানিয়ে নীবর বেদনা ও অভিমানে গোপন অশ্রুতে বিদায় নিয়েছেন। এ আত্মহনন কোনো সাধারণ আত্মহত্যা নয়, এ যে আমাদের অবক্ষিত সমাজ ও রাষ্ট্রের বেদীমূলে তীব্র চপেটাঘাত, এ যে অন্যায় আর বৈষম্যের মেরুদণ্ডে মার্তণ্ড আঘাত।
লেখক : কবি, সমাজকর্মী ও ব্যাংকার