কাদের ভুলে ফিলিস্তিনিরা আজ রাষ্ট্রহারা?

: রেজাউল করিম
প্রকাশ: ১৫ ঘন্টা আগে
ছবি : রেজাউল করিম (লেখক)

একটা সাধারণ পারসেপসন আছে, ব্রিটিশরা ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছে। কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় এ ধারণার প্রতিফলন তেমন দেখা যায় না। ইহুদিরাই ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের সহযোগিতা করেছে আমেরিকা। এটা হল বাস্তবতা।

ব্রিটিশরা বেলফোর ঘোষণা করে ইহদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের সমর্থনের কথা বলেছে। ঐ পর্যন্তই। ব্রিটিশরা ছিল কৌশলী। তারা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা সংখ্যালঘু ইহুদিদের সরাসরি পক্ষ নিয়ে মুসলিম বিশ্বকে বিপক্ষে ঠেলে দিতে চায়নি। প্রথমদিকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনি মুসলিমদের নিকট থেকে জমি কিনতে থাকে। তারপরে সেখানে অভিবাসী ইহুদিরা বসতি স্থাপন করতে থাকে। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় এলে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন আরবরা এর প্রতিবাদ করে। তখন ব্রিটিশ সরকার অভিবাসীদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনি বিষয়ক একটি নীতি ঘোষণা করে। সে নীতির মধ্যে একটি ছিল আগামী পাঁচ বছরে ৭৫০০০ ইহুদি ফিলিস্তিনে আসতে পারবে। এর বেশি নয়। আরেকটি ছিল জমি ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে জার্মানদের জয়জয়কার অবস্থা। জার্মানি ও জার্মান অধিকৃত অঞ্চলে ইহুদিরা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ইস্ট্রমা নামক এক জাহাজ রুমানিয়া থেকে ইহুদিদের নিয়ে ফিলিস্তিনি যাচ্ছিল। আরবদের প্রতিবাদের কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে ফিলিস্তিনে ভিড়তে দেয়নি। এরপর জাহাজটি ইস্তাম্বুল যায়। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ সেটিকে কৃষ্ণসাগরে পাঠিয়ে দেয়। দেন-দরবার চলতে চলতে ১৯৪১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি বিকট শব্দ করে তলিয়ে যায়। ফলে ৭৭৮ জন অভিবাসী মারা যান। এ ঘটনায় সমগ্র বিশ্বের ইহুদিদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৫ সালের ৩১ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে ফিলিস্তিনে অবিলম্বে এক লক্ষ ইহুদি প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেন। ব্রিটিশ সরকার এ অনুরোধ পছন্দ করেনি। তারা এ অনুরোধ গিলতেও পারে না, ফেলতেও পারে না। শেষে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিন কী পরিমাণ অভিবাসী ধারণ করতে পারবে তার জন্য একটি কমিশন গঠন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিরা হত্যা নির্যান্তনের শিকার হলে তারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। আরবরা এর চরম বিরোধিতা করে। তখন ইহুদিরা ফিলিস্তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং আরব উভয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম শুরু করে। অনেক পুলিশ ফাঁড়ি, স্থাপনা আক্রান্ত হয়। অনেক সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের অপহরণ, আক্রমণ করতে থাকে। এতে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, তারা ১৯৪৮ সালের ১ আগস্টের মধ্যে ফিলিস্তিনে ম্যান্ডেটরি শাসন শেষ করবে।

একদিকে আমেরিকার চাপ, ইহুদিদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অন্যদিকে আরবেদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ফিলিস্তিনের পরিবেশ পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও জটিল আকার ধারণ করে। আইন-শৃঙ্খলার দারুণ অবনতি হয়। বিষয়টি সুরাহার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালে ২ এপ্রিল ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন আহ্বানের অনুরোধ জানায়। ১৫ মে পর্যন্ত দীর্ঘ আলোচনা হয়। অবশেষে বিষয়টি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের লক্ষ্যে বৃহৎ শক্তিকে বাদ দিয়ে সুইডেনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। তারা ৩১ আগস্ট জাতিসংঘে রিপোর্ট ও সুপারিশ পেশ করে। ১১ সদস্যের ৮ সদস্য ( সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পেরু, উরুগুয়ে, গুয়েতেমালা, হল্যান্ড, চেকোশ্লাভিয়া) ফিলিস্তিনকে একটি আরব ও একটি ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পক্ষে এবং জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষে সুপারিশ করে। অন্যদিকে ১১ সদস্যের ৩ সদস্য ( ভারত, ইরান ও যুগোশ্লাভিয়া ) আরব ও ইহুদি অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে একটা ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দেয়। এ সুপারিশ নিয়ে জাতিসংঘে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠের সুপারিশ পাস হয় অর্থাৎ ফিলিস্তিনকে একটি আরব ও একটি ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করা এবং জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ৩৩, বিপক্ষে ১৩ ভোট পড়ে এবং ১০ জন ভোটদানে বিরত থাকে। ম্যানডেটরি শাসন প্রত্যাহারের দুই মাসের মধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৫ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয় এবং নিরাপত্তা পরিষদকে সহযোগিতার অনুরোধ করা হয়।

জাতিসংঘ কর্তৃক ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা পাসের পর আরবরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। তারা জীবন দেবে, তবুও ফিলিস্তিন বিভক্ত হতে দেবে না। এমনকি তারা জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ শুধু সুপারিশ করতে পারে, বাধ্যতামূলকভাবে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা ফিলিস্তিনে তিন দিনের ধর্মঘটের ডাক দেয়। ইহুদিরা এ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। তবে তারাও বসে থাকেনি। তারা আরবদের আক্রমণ করে। ফিলিস্তিনি আরবদের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলো থেকে স্বেচ্ছাসেবিরা এগিয়ে আসে। সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটেন ঘোষণা করে, যেহেতু আরব ও ইহুদিরা জাতিসংঘের পরিকল্পনার ব্যাপারে একমত পোষণ করেনি, তাই এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং তারা জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে সহযোহিতা করবে না। ব্রিটেন আরো ঘোষণা করে, তারা পূর্ব ঘোষিত ১ আগস্টের পরিবর্তে ১৫ মে, ১৯৪৮ এর মধ্যে ম্যানডেটরি শাসন প্রত্যাহার করে নেবে। আমেরিকা তখন ইহুদিদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৯ মার্চ আমেরিকা আরেকটি প্রস্তাব দেয়, যেহেতু ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা যাচ্ছে না সেহেতু ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের অছি পরিষদের উপর ন্যস্ত করা হোক। ইহুদিরা এটা মানেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন আগের প্রস্তাবের পক্ষে ছিল। নতুন প্রস্তাবের পক্ষে তেমন সাড়া মেলেনি।

এমতাবস্থায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের উপর থেকে ম্যানডেটরি শাসনের অবসান ঘোষণা করে। সেদিনই তেলআবিবে ইহুদিদের জাতীয় পরিষদ ‘ইসরায়েল’ নামে একটি রাষ্ট্র ঘোষণা করে। নবগঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন ড. ওয়াইজম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী হন ডেভিড বেন গুরিয়ন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রম্যান যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন। সেদিনই এ নব গঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে সৌদি আরব, মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ট্রান্স জর্ডান, লেবানন তিন দিক থেকে ইসরায়েল আক্রমণ করে। যুদ্ধের প্রথম দিকে আরবরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। ইসরায়েল ছিল কোনঠাসা। কেননা মাত্র ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা, সঙ্গে সঙ্গে তিনদিক থেকে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের আক্রমন- এটা তো ঘাবড়ানোরই কথা। যা-েই হোক, ধীরে ধীরে যুদ্ধের গতি ইসরায়েলের অনুকূলে মোড় নেয়। ইহুদিরা প্রতিটি রণাঙ্গলে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে। এতে আরবরা আবার ঘাবড়িয়ে যায়। তারা ভেবেছিল ইসরায়েল ছোট একটি নতুন রাষ্ট্র। একে সহজেই উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে তারাই উচিত শিক্ষা পাচ্ছে। জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভাগ করে যে অংশটুকু ইহুদিদের দিতে চেয়েছিল সে অংশটুকু ইহুদিরা তো রক্ষা করেছেই, এর বাইরে প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের বেশ কিছু জায়গা দখল করে নেয়। যুদ্ধ চলে দীর্ঘদিন (১৫ মে, ১৯৪৮-১০ মার্চ, ১৯৪৯)। ১৯৪৯ সালে ইসরায়েল আক্রমণকারী আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে আলাদা আলাদা যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে। যুদ্ধবিরতির পর দেখা গেল ফিলিস্তিন মোট ভূখণ্ডের ৭০ শতাংশ ইসরায়েলের দখলে। অথচ জাতিসংঘ আরবদের ৬০ এবং ইহুদিদের ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড দিতে চেয়েছিল। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল তার বরাদ্দের চেয়েও ৩০ শতাংশ বেশি ভূমি দখলে নিতে সক্ষম হয়। ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তচ্যুত হয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (বিসিএস শিক্ষা), ইতিহাস বিভাগ

  • ইসরায়েল
  • প্রতিষ্ঠা
  • রাষ্ট্র
  • #