পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ সম্পর্কে অতীতে সে দেশের জনগণকে ভুল তথ্য জানিয়ে সবাইকে একটা অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিল সবসময়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থের ‘উটপাখি’ কবিতার বিখ্যাত এ পঙ্ক্তিটি চরম বাস্তবতার শিক্ষা দেয় বাংলাদেশ-পাকিস্তানের উন্নয় ও বৈষম্যের চিত্রে। আসলেই অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকেনা। বাংলাদেশের উত্থান ও পাকিস্তানের রসাতলে গমনের ক্ষেত্রেও কথাটি বাস্তব সত্য। সঠিক পরিকল্পনা, সময় উপযোগী লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর দেশপ্রেম যেমন একটি রাষ্ট্রকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তেমনি তার উল্টো কাজের ফলও উল্টোই হয় বলা যায়। বাংলাদেশ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সোনার বাংলা নির্মানে আত্মনিয়োগ করে। বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নসহ রচনা করতে থাকলেন ভবিষ্যৎ সোনার বাংলার রূপরেখা। যা বাস্তবায়নে আজও তাঁরই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দিন রাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
পক্ষান্তরে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও রাজনীতির অন্ধকার চোরা গলি থেকে বের হতে পারেনি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি। ১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃত মালিক ওই দেশের সেনাবাহিনী, গত ৭৪ বছরেও এ বাস্তবতার কোন পরিবর্তন হয়নি। আর পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান দুর্দশার পেছনেও অন্যতম কারণ বলা চলে বিশাল এ সেনাবাহিনী পালনের অসহনীয় বোঝা। যা থেকে দেশটি কোনভাবেই বের হয়ে আসতে পারছে না। বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নে বিস্মিত বিশ্বের অনেকের মতো পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক এমনকি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও তার বক্তব্যেও উঠে আসে শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন চিত্র। মাত্র বছর কয়েক আগে পাকিস্তানের এক সাংবাদিক বলেছিলেন ‘খোদা কি ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো’। আর গত ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালে আমাদের লজ্জা হয়। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানকে দেশের বোঝা মনে করা হতো। আমি তখন খুবই ছোট ছিলামÑ আমাদের বলা হতো যে, এটা আমাদের কাঁধে একটা বোঝা। আজ আপনারা সবাই জানেন সেই বোঝা এখন কোথায় পৌঁছেছে। এখন আমরা যখন তাদের দিকে তাকাই, তখন আমরা লজ্জিত হই।’ বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের জন্য লজ্জার। পাকিস্তানের ডন পত্রিকা জানায় করাচিতে সিন্ধু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্যে বাংলাদেশ নিয়ে এমন লজ্জার কথা বলেন শাহবাজ শরিফ। কিন্তু বাংলাদেশের তথাকথিত বিরোধী দলগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে পায় না।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন। শিল্পের জন্য প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস। বাংলাদেশে সড়ক ও রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সারাদেশকে যোগাযোগের নেটওয়ার্কে নিয়ে আসা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ, মাতারবাড়ি ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের সেবা পাচ্ছে অন্যদিকে এখনো পাকিস্তানের ২৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৮০ টাকা, যা তৎকালীন ৯৪ মার্কিন ডলারের সমান। মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলার ছাড়াতে ৩১ বছর সময় লাগে বাংলাদেশের। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় হয় ৫১০ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪ ডলার। পরের সাত বছরেই তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। দ্রুত বাড়তে থাকে বাংলাদেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সঙ্গে বাড়ে মাথাপিছু আয়। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শেখ হাসিনার জাদুকরী নেতৃত্বে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ। ওই অর্থবছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় হয় ১ হাজার ৪৫৯ ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫১ ডলার। এভাবেই স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের লড়াইয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি যেখানে ৬ শতাংশের উপরে সেখানে পাকিস্তানের গড় প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের নিচে।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। স্বাধীনতার পর মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (পিবিএস) তথ্য বলছে দেশটির মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি কখনো স্থিতিশীল ছিল না। কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। পুরো সত্তরের দশকের সময়টি তাদের লাগে ২০০ ডলার থেকে মাথাপিছু আয় ৩০০ ডলারে উন্নীত হতে। আশির দশকজুড়ে মাথাপিছু আয় বাড়ে আরও এক শ ডলার। ওই দুই দশক সামরিক শাসনের আধিপত্য ছিল। ২০০০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় বেড়ে হাজার ডলার পেরোয়। আর গত দশ বছরে তা বেড়েছে মাত্র ৫০০ ডলারের কিছুটা বেশি। সর্বশেষ ২০২৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৭১ ডলার।
রপ্তানি আয়েও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। যেখানে বাংলাদেশ এখন পোশাক রপ্তানিতে সারা বিশ্বে দ্বিতীয় পাকিস্তান সেখানে দশের মধ্যেও নেই। সব মিলিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান গত অর্থবছরে ৩.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখন ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৬৭ শতাংশে। গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় অপরিবর্তিত আছে। তবে কোনোটিই দুই অঙ্কের ঘরে নেই। অন্যদিকে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি এখন অতিমাত্রায় বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপে পাকিস্তানের মানুষ পিষ্ট। পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে ছিল ২৮.৩ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালের মে মাসে রেকর্ড ৩৮ শতাংশ ছিল।
বিগত পনেরো বছরে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। শতভাগ বিদ্যুৎ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা-কক্সবাজার রেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ি ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু, দেশজুড়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে বলা হয় ‘এশিয়ান এমার্জিং টাইগার’ অন্যদিকে পাকিস্তানকে বলা হয় ‘সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য।’বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়ন প্রকল্প গ্রহন ও দারিদ্র্যের হার যেখানে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ সেখানে পাকিস্তানে দারিদ্র্যোর হার এখন ৩৯.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তাঁর গতিশীল ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের জন্যই এমন অভাবনীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে। যা এখন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জন্য লজ্জার।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট