৩৫ বছর বয়সী নারী উম্মে সাহেদীনা টুনি, নিজের কিডনি দিয়ে স্বামীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। তবে সেই স্বামী সুস্থ হয়ে উল্টা পরকীয়া ও অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়লেন । শুধু তা-ই নয়, বরং স্ত্রীকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে তিনি বসবাস করছেন । সাভারের কলমা এলাকায় এমন অমানবিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে। অকৃতজ্ঞ স্বামী তারেকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা করেছেন টুনি। তারেক গ্রেপ্তার হলেও বর্তমানে জামিনে আছেন।
বিয়ের দুই বছরের মাথায় দুঃসংবাদ পান টুনি। টুনি জানতে পারেন- তার স্বামী মোহাম্মদ তারেকের দুটি কিডনি প্রায় অচল। তাকে বাঁচাতে নিয়মিত ডায়ালাইসিস ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অথচ এর মাত্র এক বছর আগে সন্তানের মা হয়েছেন টুনি, সংসার জীবনেরও সবে দুই বছর পার হয়েছে। এমন সময়ে এই দুঃসংবাদ তার জীবনের সবকিছু ভণ্ডল করে দেয়। তবে, ভালোবাসার বাঁধন বড়ই শক্ত। টুনি স্বামীর হাত শক্ত করে ধরেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেককে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
পরিকল্পনামাফিক তারেকের চিকিৎসা শুরু হয় ভারতে। কয়েক বছর পর চিকিৎসকরা জানান, রোগীকে বাঁচাতে হলে অতিদ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। তখন স্ত্রী টুনিই এগিয়ে আসেন। নিজের কিডনি দিয়ে তিনি স্বামীকে প্রাণে বাঁচান। টুনি ভেবেছিলেন, এবার হয়তো তার কষ্টের জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু তারেকের এমন কর্মকাণ্ড বিষয়টিকে ভুল প্রমাণ করেছে। সুস্থ হয়েই পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন তারেক । ডিভোর্সি এক নারীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার নেশাও পেয়ে বসে তাকে। যেই স্ত্রীর কারণে নতুন জীবন তিনি ফিরে পেলেন, একসময় তাকেই মারধর করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে মারধর করে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে গিয়ে ওঠেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে টুনি বলেন, তারেককে কিডনি দেওয়ার পর আমার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে চলে যায়। সাতদিন আইসিইউতে রাখা হয়। আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে আসার পরই যেন অন্য এক তারেককে আবিষ্কার করলাম। যেই মানুষটার জন্য আমার সবকিছু ত্যাগ করেছি, নিজের জীবন দিয়ে হলেও তাকে বাঁচাতে চেয়েছি; সেই কিনা কিডনি পেয়ে সুস্থ হয়েই হাসপাতালে আমার সঙ্গে চিৎকার করতে শুরু করল, মারতে উদ্যত হল। আমার এক খালা কেন অপারেশনের আগে টাকা পাঠাতে দেরি করেছিল- এমনটা বলে চিল্লাচিল্লি করল।
সেদিন তারেকের এমন কর্মকাণ্ড দেখে হাসপাতালের চিকিৎসকরাও অবাক হন। টুনির ভাষ্য, এরপর আমাদের দুজনকে সেই চিকিৎসক তার চেম্বারে ডেকে নেন, যিনি অপারেশনটা করেছিলেন। সেখানে তারেককে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘যদি তোমার মা হয় তোমার জন্মদাতা, এই নারী তোমার জীবনদাতা। এর কারণে তুমি পুনরায় জীবন পেয়েছ, সুস্থতা ফিরে পেয়েছ। তার সঙ্গে কীভাবে এমন দুর্ব্যবহার করতে পারলে । এরপর চুপ হয়ে যান তারেক। পরে আমরা দেশে ফিরে আসি।
ঢাকায় ফেরার পরই টুনির জীবনে নেমে আসে নরক। টুনি বলেন- সুস্থ হয়ে তারেক নতুন কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসা শুরু তো দূরের কথা উল্টো স্ত্রীকে চাপ দেন উপার্জনের সব টাকা তার হাতে তুলে দিতে এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে আরও টাকা নিয়ে আসতে। একপর্যায়ে অনলাইন জুয়া ও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে তারেক। যেই স্ত্রীর জন্য নিজের জীবন ফিরে পেলেন, তার গায়ে হাত তুলতে শুরু করেন।
টুনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় কাজের অজুহাতে ঢাকায় গিয়ে সময় কাটাত তারেক। একসময় জানতে পারি, তাহমিনা নামের একজন ডিভোর্সি নারীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরকীয়ায় লিপ্ত সে। তারেকের মোবাইল ঘেঁটে এসবের প্রমাণও পাই। বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, সে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে আমাকে পুরো বাড়ি তার নামে লিখে দিয়ে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য চাপ দেয়।
এ প্রসঙ্গে টুনি বলেন, আমার স্বামীকে আমি সবসময় ফেরেশতার মতো মনে করতাম। ভাবতাম, তিনি কখনোই মিথ্যা বলেন না। তবে, আমার পরিবারের মানুষ ধাপে ধাপে সতর্ক করেছিল। কারো কথা কানে নিইনি। বরং তারেকের কথায়, অনেক সময় পরিবারের মানুষদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেছি। অথচ সেই মানুষটা আজ আমার সব কেড়ে নিল। তাকে কিডনি দেওয়ার পরে আমার শারীরিক অবস্থাও দিনদিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরাও নানাভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমি জানি, সুস্থভাবে হয়তো বেশিদিন আর বাঁচতে পারব না। তবুও যেই মানুষটার কষ্ট কখনো নিজের চোখে দেখতে পারতাম না, যার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছি, সেই কিনা আমাকে এভাবে ঠকালো! আমার পেটে অপারেশনের জায়গাতে লাথি মারল…! আমি চাই না, আমার মতো পরিণতি আর কোনো মেয়ের হোক। আর কোনো মেয়ে যেন ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে নিজের জীবনকে এমন অন্ধকারে না ঠেলে দেয়।’
এ প্রসঙ্গে টুনির মা বলেন, পারিবারিকভাবে আমাদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। তারেকের চিকিৎসায় প্রতি বছর গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হতো। সেই টাকা টুনি কখনো আমাদের থেকেও নিয়ে যেতো। আমার পেনশনের পুরো অর্থ তারেকের চিকিৎসায় খরচ করেছি। একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে টুনিদের থাকার জন্য বিল্ডিং তুলে দিয়েছিলাম। সেই বাড়ির অর্ধেক মেয়ের নামে আর বাকি অর্ধেক তারেকের নামে। অথচ আজ সেই বাড়ি নিজের নামে লিখে দেওয়ার জন্য আমার মেয়েকে নির্যাতন করছে, পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে থাকছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা তারেকের প্রতারণার কঠিন শাস্তি চাই। যেন আমার মেয়ের মতো কোনো মেয়ের জীবন এভাবে ধ্বংস না হয়।
মামলা প্রসঙ্গে টুনির আইনজীবী নেহার ফারুক বলেন, দিনের পর দিন আমার বাদীকে নির্যাতন করে গেছেন তারেক। একটা মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ হলে, যার দয়ায় আজ তিনি বেঁচে আছেন, তার সঙ্গেই এমন করতে পারেন? আমরা এখনো মামলার চার্জশিট হাতে পাইনি। চার্জশিট হাতে পেলেই তারেকের জামিন বাতিলের আবেদন করব। আমার বিশ্বাস, এই ঘটনায় আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবেন আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান টুনি-তারেকের এই ঘটনাকে অত্যন্ত মর্মান্তিক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, যেই নারী তারেককে প্রাণে বাঁচাতে নিজের কিডনি দিয়েছেন, বিয়ের দুই বছর পর স্বামীর এমন অবস্থা আবিষ্কার করেও হাত ছেড়ে যাননি, অথচ সুস্থ হয়ে কিনা তার ওপরই নির্যাতন শুরু করেছেন। এ ধরনের প্রতারকদের কারণে স্বামী-স্ত্রীর সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতিও মানুষের অবিশ্বাস তৈরি হয়।
ইশরাত হাসান বলেন, কেবল নারী নির্যাতন নয়, টুনির উচিত মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনেও তারেকের বিরুদ্ধে মামলা করা। কারণ, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তিনি স্ত্রীর কিডনি নিয়েছেন, পরে তার ওপর নির্যাতন শুরু করেছেন। এমনকি বিয়ের এত বছরেও স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাননি, সেই ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন। এসব ঘটনায় একজন আসামির দ্বারা বাদীর ক্ষতি সাধনেরও শঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে টুনির উচিত হবে আদালতের কাছ থেকে সুরক্ষা আদেশ নেওয়া। যেন তিনি নিজ বাড়িতে সুরক্ষিত থাকতে পারেন।
সূত্র : ইত্তেফাক