কথাসাহিত্যিক আব্দুল্লাহ শুভ্র আবারও নিখুঁত বুনন নিয়ে ‘কালপিয়াসী জ্যোৎস্না’র পূর্ণাঙ্গ অবয়ব সৃষ্টি করেছেন। এ অবয়বে আছে তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধের বুননকৌশল।
তাতে যেমন অভিমানী সত্তার একরোখা জেদ, প্রেম-ভালোবাসার নতুন নতুন দ্যোতনা, অবিনাশী আদর্শের বিশ্বজনীন রূপ মানবতা, প্রচলিত সমাজকাঠামোর বিশ্বাস ও ধর্মাচারণের সহজ ও সরল প্রকাশ; তেমনি জীবন্ত হয়ে উঠেছে মা, মাটি ও পলিকণা বুকের কোণে লালন-পালন করা অনমনীয় সত্তা, প্রজন্মের গুণটানা নৌকা চালিয়ে যাওয়ার অবিরত সংগ্রাম। সর্বোপরি সাহিত্যের সোমরস কিংবা গরলে আসক্ত জাত-পাতহীন মানস সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষায়, আবার কোথাও কোথাও লোকায়ত ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তার বুনন প্রক্রিয়ায় পাঠকমানস অজান্তে হাসার কিংবা কাঁদার এক অনিন্দ্য সুন্দর রসদ পাবে এ উপন্যাসটিতে।
উপন্যাসটিতে লোকজ ভাষার উপস্থিতি চিরায়ত সমাজব্যবস্থার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, সূক্ষ্ম বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ ও মান-অভিমান প্রকাশের অসাধারণত্ব সৃষ্টিতে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।
‘কালপিয়াসী জ্যোৎস্না’ উপন্যাসের আবহ, সময় ও স্থান নিরূপণে কথাসাহিত্যিক তার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ইতিহাসের ধারায় নজর দিয়েছেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের প্রসববেদনার সময়কালকে চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও আমাদের জাতিসত্তার ব্যথা, বেদনার দিকটিও অকপট চিত্তে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
সত্তরের প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড় সারাজীবন দুটো সত্তার মনস্তত্ত্বে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে- এমন একটি দিক সবচেয়ে বেশি করে ধরা পড়েছে আমার পাঠকমানসে। ভোলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই ঘূর্ণিঝড় উপন্যাসের মূল চরিত্র আমিরুজ্জামান ও তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে তাপসের মনস্তত্ত্বে বছরের পর বছর বয়ে যাচ্ছিল। কথাসাহিত্যিক আব্দুল্লাহ শুভ্র তার বুনননৈপুণ্যে তাদের ভেতরের এ ঘূর্ণিঝড় প্রশমিত করতে সক্ষম হন।
জেদি ও অভিমানী সত্তা আমিরুজ্জান তার স্ত্রী লতিফার প্রেমাসক্ত মানস অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে একরোখা সিদ্ধান্ত নেন এবং তাপসকে নিয়ে ঘর ছাড়েন। এ ঘরছাড়া ও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়া- উপন্যাস কাঠামোতে শক্তিশালী বুননকৌশল সৃষ্টিতে অবদান রাখে। আমিরুজ্জামানের দুটো ছেলেমেয়ে তাপস ও বকুল। কেনইবা ছেলেসন্তানকে নিয়ে ঘর ছাড়েন, মেয়েকে নিয়ে নয়; তা কি তার মানসে লালিত পুরুষতান্ত্রিকতার জন্য- বিষয়টি পাঠকমনকে ভাবায়।
মানবতা ও মাতৃত্ব উপন্যাসটিতে সমার্থক অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। নিঃসন্তান দম্পতি বিষু মল্লিক ও সীতা রানী নদীর বুকে ভেসে আসা তাপসকে জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতা ও মাতৃস্নেহ দিয়ে বুকে তুলে নেন। সীতা রানী তার নিজ ধর্মের বলয় ভেঙে তাপসকে মুসলমানি করায়। কিন্তু সেই মুসলমান পাকবাহিনীর হাতে বিষু-সীতা দম্পতিকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। আবার তাপসের এই মুসলমানিই মুক্তিযুদ্ধকালে দেশছাড়ার সময় পথে তাকে ও বলরামকে রক্ষা করে পাকসেনাদের হাত থেকে।
দেশপ্রেম, বিপ্লবী চেতনা, মাতৃসম দেশকে রক্ষার শপথ শহিদ মিজান হাওলাদার ও আমিরুজ্জামানের ছোটভাই শহিদ খায়রুজ্জামানের চরিত্রে ফুটে উঠেছে। অশিক্ষিত খায়েরুজ্জামান চিরকুমার বিপ্লবী মিজান হাওলাদারের বিপ্লবী মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে নববিবাহিতা চকোরীর দাম্পত্য সঙ্গ উপেক্ষা করে দেশমাতৃকার জন্য শহিদ হতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। আর তীব্র ক্ষোভ ও দ্রোহ থাকা সত্ত্বেও আমিরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি- বিচিত্র মানবমনেরই যেন আরেক রূপ আমার পাঠকমানসে ধরা পড়ে।
প্রজন্মের বহমান জীবনের নৌকা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উপন্যাসের প্রধান দুই নারী চরিত্র লতিফা ও চকোরী কঠিন দায়িত্বশীলতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেক্ষেত্রে চকোরী তার যৌনজীবনকে অবদমিত করে আমিরুজ্জামান-লতিফার কন্যা বকুল এবং খায়রুজ্জামান ও তার সন্তান আমিরজানকে আত্মপরিচয়ের শিখরে নিয়ে যেতে মুখ্য দায়িত্ব পালন করে। পুরো উপন্যাসে লতিফা, চকোরী, আমিরুজ্জামান, বলরাম ও বুলুর জীবনে যৌনতা-কামনা-বাসনার দিকটি অবদমিত অবস্থায় থেকে যায়।
প্রেম-ভালোবাসার দিকটি বিশ্লেষণ করলে চকোরী-আমিরুজ্জামানের মনোটান উপন্যাসকাঠামোতে এক অসাধারণ রোম্যান্স সৃষ্টি করেছে। ছাত্রী-শিক্ষকের এ প্রেম অনন্য মাত্রা দিয়েছে উপন্যাসটিতে। ‘মুই তো আমনেরে বোজতে চাই’- চকোরীর অংক বোঝার চেয়ে মন বোঝায় আগ্রহ আমিরুজ্জামানের মনকে কাবু করতে সক্ষম হয়েছে।
মনস্তত্ত্বে ঘূর্ণিঝড় বয়ে বেড়ানো সত্তা আমিরুজ্জামান নিঃসঙ্গ জীবনে প্রজন্ম-পরম্পরার দিকটি ধারণ করে তাপসকে তার মানসভাবনায় সবসময় বিচরণ করান। অপরদিকে, মনস্তত্ত্বে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে বয়ে বেড়ানো সত্তা তাপসও শেকড়ের সন্ধানে খুঁজে চলে বাবা, মা ও দেশকে। এ খোঁজাখুঁজির ঘটনাপ্রবাহ পাঠকমানসকে নেশার মতো করে টানে।
মানসে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় প্রশমিত করা, বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ‘বয়া’ নিয়ে চলা অতৃপ্ত আত্মাগুলোকে এক দ্বীপে আনয়ন, একরোখা জেদি ও অভিমানী সত্তার আত্মোনুসোচনা ও মৃত্যুকে এক অভাবনীয় কারুকাজে বুনন করেছেন কথাসাহিত্যিক আব্দুল্লাহ শুভ্র। মানসের ঘূর্ণিঝড় দিয়ে সৃজনশীল সত্তা সৃষ্টির অসাধারণত্বও তার তুলিতে অঙ্কিত হয়েছে। সর্বোপরি জাত-পাতহীন তাপসের লেখকমানস চরিত্রটি প্রজন্ম-পরম্পরায় এক অক্ষয় দাগ রেখে যাবে।
‘কালপিয়াসী জ্যোৎস্না’র জাত-পাতহীন লেখকমানসটি আব্দুল্লাহ শুভ্রর এক অক্ষয় লেখকমানস হিসেবেই আমার কাছে বিবেচিত। এ উপন্যাসটির কোনো কোনো ঘটনাপ্রবাহে প্রত্যেক পাঠক তার নিজের সত্তার উপস্থিতি টের পাবেন অজান্তে ও অবলীলায়। এক্ষেত্রে পাঠকমানসে ক্ষুধা সৃষ্টি ও ক্ষুধা নিবারণে কথাসাহিত্যিক আব্দুল্লাহ শুভ্র সফল ও সার্থক। তাই নিরঙ্কুশ বলা যায়- বাংলাসাহিত্যে দীর্ঘকালের খরায় এক পশলা বৃষ্টিই যেন ‘কালপিয়াসী জ্যোৎস্না’।