সীমাহীন লুটপাট হচ্ছে সিলেটের ‘সাদাপাথর’, অভিযোগে বিএনপির নেতার পদ স্থগিত

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ ঘন্টা আগে

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করেছে দলটি। রোববার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক পত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সেখানে বলা হয়, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিএনপির আদর্শ ও নীতি পরিপন্থি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সকল পদ স্থগিত করা হয়েছে।

এদিকে সিলেটের পাথর রাজ্যে এখন আর পাথর নেই। চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। এক বছর আগেও যেখানে ছিল পাথরের স্তূপ সেখানে এখন ধুধু মাঠ। দিনরাত শত শত নৌকা দিয়ে প্রকাশ্যে বালু-পাথর লুটপাট হলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। একাধিকবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান।

কালবেলা এ নিয়ে শুরু থেকে সংবাদ প্রকাশ করে তুলে এনেছে লুটপাটের আদ্যপ্রান্ত। পাথর রাজ্যে লুটপাটে বিএনপি, যুবদল, জামায়াত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির ৪টি ক্যাম্প ও চেকপোস্ট থাকলেও সবাই ছিল নীরব দর্শক। মাঝে মধ্যে অভিযান হলেও আগেই খবর জেনে যেত লুটেরা।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে নির্বিচারে চলে সাদাপাথরের পাথর লুট। গত এক সপ্তাহে শেষ হওয়া সাদাপাথরে মরণ কামড় দেয় লুটেরা। লুটপাটে যেন সবাই ঐক্যবদ্ধ। তবে, লুটের নেতৃত্বে ছিল স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের নেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছিলেন লুটের নেপথ্য কারিগর।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের ধলাই নদীর উৎসমুখ থেকে শত শত নৌকা দিয়ে লুট হয় পাথর। মূল স্পটের বাম পাশের বড় বড় পাথর নেই। কোথাও কোথাও বালুচর জেগে উঠেছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি করা হয়েছে। বড় পাথরের পাশাপাশি ছোট-ছোট পাথরও লুট হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। এত লুটপাট তারপরও বিজিবি, পুলিশ, প্রশাসন যেন সবাই নীরব দর্শক। এছাড়াও পাথরবোঝাই শত শত নৌকার মাঝে পর্যটকবাহী নৌকাও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। ফলে পাথর রাজ্যের সৌন্দর্য হারিয়েছে। যার ফলে এ পর্যটনস্পটের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন পর্যটকরা। স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা বা প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পাননি। বরং যত সময় যাচ্ছে ততই যেন বেপোরোয়া হয়ে উঠছে লুটপাটকারিরা।

এলাকাবাসী জানান, এ অবস্থায় দেশের পর্যটকদের কাছে পরিচিত সাদা পাথর পর্যটন স্পটটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে পরিচর্যা না করলে সরকার হারাবে বড় অঙ্কের রাজস্ব।

স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের উদাসীনতা ও টিলেঢালা নজরদারির কারণে পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিযান দিলেও তার প্রভাব থাকে সামান্য সময়। এরপর আবারও লুটপাট চলে।

পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, গত এক বছরে ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য দুইশত কোটি টাকার অধিক।

লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলন কমিটির যুগ্ম আহবায়ক এস কে দাস সুমন কালবেলাকে বলেন, দেশের বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য দীর্ঘদিন থেকেই হুমকির মুখে, দখল আর লুটপাটে সৌন্দর্য হারিয়েছে অনেক আগেই। বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক স্থানগুলো যেখানে সরকারি দিক নির্দেশনায় পরিচালিত হয় সেখানে আমাদের দেশে নজরদারির অভাব আর অবহেলায় প্রায় নিঃস্ব হতে চলেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

তিনি বলেন, সিলেটের সাদাপাথর যেখানে সিলেটের সুনাম দেশ-বিদেশে বৃদ্ধি করেছিল সেখানে এক ভয়াবহ লুটপাট আর দখলে আজ সৌন্দর্য হারিয়েছে। প্রশাসনের সঠিক তদারকি আর সরকারের অবহেলায় ধংস হয়েছে এই সুন্দর প্রকৃতি। আমরা সাদাপাথর ধংসে যারা জড়িত তাদের আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগে বিচারের দাবি জানাই সরকারের কাছে।

সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল করিম কিন ক্ষোভের সঙ্গে কালবেলাকে বলেন, প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকাতেই সাদাপাথর শেষ হয়ে গেছে। বিগত এক বছর ধরে গণমাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবেদন ও পরিবেশকর্মীদের সতর্কতা উপেক্ষা করে পাথরখেকোদের লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা হয় সীমান্তবর্তী ধলাই নদের উৎসমুখ। পর্যটকরা ধলাই নদের উৎসমুখে উজান থেকে গড়িয়ে আসা পাথরের যে সৌন্দর্য অবলোকন করতে বহুদূর থেকে ছুটে আসতেন, সেখানে এখন ধুধু বালুচর। পাথর খেকোদের সৃষ্ট গর্তে মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, বিগত এক বছরে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানসমূহ সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর দায় খনিজ সম্পদ ও পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অতীতে সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শ্রীপুর, লোভাছড়া এলাকার পাথর লুণ্ঠন বন্ধে কী করতে হবে সে-সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করতেন, আইনি লড়াই করতেন। সভা-সেমিনারে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় অনেক কথাই বলতেন কিন্তু সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ উনার দায়িত্ব পালনকালে বিনাশ হয়ে যাওয়ার ব্যর্থতায় একজন পরিবেশকর্মী হিসাবে ব্যথিত ও বিব্রত।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, সাদাপাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে। ৭০ জনের মতো আসািম গ্রেপ্তারও হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সাদাপাথর লুটপাট ঠেকাতে বড় অভিযানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা বলেন, জাফলং যেমনি ইকোলজিক্যালি এরিয়া, তেমনি সাদাপাথর নয়। যে কারণে সাদাপাথরে অভিযান চালাতে পারি না। ইতোমধ্যে জাফলংয়ে অভিযানে ১২টার বেশি মামলা করেছি। তারপর জেলা প্রশাসন থেকে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হলে আমরা সংযুক্ত থাকি। মূলত এটি খনিজসম্পদের আওতায়। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আমলযোগ্য নয়। যেমনটি লোভাছড়াতে অভিযান চালিয়ে মামলা করতে গেলে খনিজসম্পদ থেকে চিঠি দিয়ে বাধা দেয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী  বলেন, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এ ধরনের লুটপাট হয়েছে। প্রশাসনের উচিত ছিল আরও আগে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সচেতন নাগরিকদেরও এ ব্যাপারে আরো স্বোচ্ছার হতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও এর সাথে জড়িত।

বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দিকী বলেন, লুটপাটকারীদের কোনো দল হতে পারে না। আমরা বারবার প্রশাসনকে বলেছি, লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পতিত সরকারের অনেক ঘাপটি মেরে বসে আছে, তারাই এসব লুটপাটে জড়িত।

তিনি বলেন, প্রক্রিয়াগতভাবে পাথর উত্তোলন করলে আজকের অবস্থার সৃষ্টি হতো না। একদিকে পাথর উত্তোলন বন্ধ অন্যদিকে লুটেরাদের সুযোগ করে দেওয়ার দায় প্রশাসনকে নিতে হবে।

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহমুদ মুরাদ বলেন, সাদাপাথরে লুটপাট বন্ধে প্রশাসন সর্ব্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই অভিযান হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

  • অভিযোগ
  • পদ
  • বিএনপির নেতা
  • লুটপাট
  • সাদাপাথর
  • স্থগিত
  • #