মৌলবাদের বেড়াজালে নারী স্বাধীনতা : প্রতিরোধ, আপস নাকি নীরবতা?

: মারুফা ইয়াসমিন অন্তরা
প্রকাশ: ১ সপ্তাহ আগে

বাংলাদেশে মৌলবাদ এবং নারীর স্বাধীনতা সবসময়ই এক জটিল প্রেক্ষাপট তৈরি করে। মৌলবাদ বলতে ধর্মীয় অনুশাসনকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোরভাবে অনুসরণ করার মতবাদকে বোঝায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এটি নারীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করে। পোশাক, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, এবং চলাফেরার ওপর আরোপিত নিয়মগুলো নারীর স্বাধীনতাকে সীমিত করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মৌলবাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। নারীর চলাফেরাসহ, পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গন এবং কর্মক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম আরোপ করা হচ্ছে।

২০২৪-২০২৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পোশাক নিয়ে যে বিতর্কিত নিয়ম আরোপ হয়েছে, তা মৌলবাদের প্রভাবের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। দেশের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে কলেজ ও মাদ্রাসায়, শিক্ষার্থীদের জন্য কঠোর পোশাক বিধি আরোপ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কলেজে ছাত্রীদের জন্য বোরকা বা হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা আগে ঐচ্ছিক ছিল। বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এ বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়নি, ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে নিয়ম তৈরি করছে। এর ফলে অনেক ছাত্রী নিজেদের পছন্দের পোশাক পরতে না পেরে মানসিক চাপে ভুগছেন।

পোশাকের নিয়ম শুধু শিক্ষাঙ্গনেই সীমাবদ্ধ নয়। সম্প্রতি, বাংলাদেশ ব্যাংক এর মতো কিছু প্রতিষ্ঠানেও পোশাক নিয়ে অলিখিত নিয়মকানুন জারি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, কর্মজীবীরা বলছেন, তাদের ওপর নির্দিষ্ট পোশাক পরার জন্য মৌখিকভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে, কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীদের স্বাধীনতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই ধরনের নিয়ম নারীদের পেশাগত জীবনকে প্রভাবিত করে এবং তাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নারীরা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছেনঃ প্রতিরোধ, মানিয়ে নেওয়া এবং নীরব সম্মতি।

প্রতিরোধ : স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য লড়াই

পোশাকের এই বিতর্ক ও নিয়ম আরোপের বিরুদ্ধে নারীদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন। কিছু নারী এই নিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তারা মনে করেন, পোশাক ব্যক্তিগত পছন্দ এবং পেশা বা শিক্ষার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। উচ্চশিক্ষিত ও পেশাজীবী নারীরা এই ধরনের নিয়মের বিরুদ্ধে অনলাইন ও অফলাইনে প্রতিবাদ করছেন। তারা মনে করেন, মৌলবাদের এই প্রভাব তাদের স্বাধীনতাকে সীমিত করছে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক নারী তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন এবং এই ধরনের নিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিছু নারী অধিকার সংগঠন এই বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। তারা মনে করেন, এই ধরনের নিয়ম সংবিধান প্রদত্ত স্বাধীনতার লঙ্ঘন।

মানিয়ে নেওয়া: পরিস্থিতির সঙ্গে আপস

অনেক নারী সরাসরি বিরোধ এড়িয়ে চলছেন এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। এই নারীরা কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাঙ্গনে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে চলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাদের পছন্দের পোশাক পরেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, পেশা বা শিক্ষা জীবনের জন্য কিছু নিয়ম মেনে নেওয়া আপস নয়, বরং একটি বাস্তবসম্মত কৌশল। অনেক ক্ষেত্রে, নারীরা তাদের পরিবার বা সমাজের চাপের কারণে এই নিয়ম মেনে নিতে বাধ্য হন। তারা জানেন যে, নিয়ম না মানলে তাদের ওপর সামাজিক চাপ বাড়বে বা তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

নীরব সম্মতি : অসহায়তা ও ভীতি

কিছু নারী এই ধরনের নিয়ম মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু নীরবতার সঙ্গে। মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রভাবের কারণে নারীরা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান। তারা মনে করেন, প্রতিবাদ করলে তারা সামাজিকভাবে একঘরে হতে পারেন বা সহিংসতার শিকার হতে পারেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নারী অধিকার আন্দোলনকারীদের ওপর মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলা হয়েছে, যা অন্যদের মনে ভীতি সৃষ্টি করেছে। অনেক নারী এই ধরনের নিয়মকে স্বাভাবিক মনে করেন এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে একদম সচেতন নন।

পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা

২০২১ সালের শুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ৭২.৮%। এই উচ্চশিক্ষিত নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং তারা মৌলবাদী ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে একটি নীরব প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) -এর এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৩৬.৩% নারী। এই কর্মজীবী নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, যা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়েছে। তবে, পোশাক নিয়ে বিতর্ক তাদের কর্মজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

মৌলবাদের ছায়ায় নারীর বিরুদ্ধে মব সন্ত্রাস

মৌলবাদী ধ্যান-ধারণার বিস্তার শুধুমাত্র অলিখিত নিয়মকানুন বা সামাজিক চাপেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কখনও কখনও নারীর প্রতি সরাসরি সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো যখন তাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে কোনো নারীকে প্রতিবাদ করতে দেখে, তখন তারা প্রায়শই দলবদ্ধ হামলার আশ্রয় নেয়। এই ধরনের হামলা সাধারণত জনসমক্ষে করা হয়, যাতে অন্যরাও ভয় পেয়ে নীরব থাকে। বিভিন্ন সময়ে নারী অধিকার আন্দোলনকারী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই সামাজিক মাধ্যমে নারী বিদ্বেষী পোস্ট ও হুমকি দিয়ে থাকে, যা পরবর্তীতে শারীরিক হামলার কারণ হয়। এই মবস্ত্রাস নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং মতপ্রকাশের অধিকারকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে এবং সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে।

২০২৪-২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের নারীরা মৌলবাদের ছায়ায় তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য একটি কঠিন লড়াই করছেন। পোশাক নিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত যে নিয়মগুলো আরোপ করা হচ্ছে, তা নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং পেশাগত জীবনের ওপর সরাসরি আঘাত। এই পরিস্থিতিতে, নারীদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন- কেউ প্রতিরোধ করছেন, কেউ মানিয়ে নিচ্ছেন, এবং কেউ নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করছেন।

ভবিষ্যতে, এই তিনটি ধারা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সমন্বয় তৈরি করবে। নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হবে। তবে, যদি মৌলবাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষ থেকে এর প্রতি সমর্থন থাকে, তবে নারীদের নীরব সম্মতি ও মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। এই লড়াইয়ে জয়ী হতে হলে, নারী ও পুরুষ উভয়ের সচেতনতা এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন অপরিহার্য।

লেখক : সিইও, ইটিসি ইভেন্টস লিমিটেড

  • নারী স্বাধীনতা
  • প্রতিরোধ
  • মৌলবাদ
  • #