রিডো নদীর রূপকথা

: চিরঞ্জীব সরকার
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

আমি বিগত দুবছর কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ছিলাম। বাসা ছিল সেন্ট পল ইউনিভার্সিটির নিকটবর্তী দ্য মেইজনড অ্যাভিনিউতে। বাসার একেবারেই কাছে রিডো রিভার যার দুপাশটা গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ থাকে গ্রীষ্মের সময়। ভরা শীতে নদীটা ঢাকা থাকে শ্বেত-শুভ্র্র বরফের চাদরে। দুবছর করোনাকালে একপ্রকার হাঁটাচলা বন্ধই ছিল। তখন এ ছোট্ট নদীটির তীরে আমার অনেক সময় কেটেছে একান্ত নির্জনে। ওর সুখ-দুঃখগুলোও যেন আমার চোখে তখন প্রতিচ্ছবিত হয়েছে স্পষ্টভাবে। নদীটির তীরে অনেকগুলি পুরানো বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে কোন পুরানো বৃক্ষকে মনে হয় এক একটা  ইতিহাসের জীবন্ত স্তম্ভ। কতশত জনের পদচিহ্ন পড়ে একটা প্রাচীন বৃক্ষের ছায়াতলে, একে একে সব হারিয়ে যায়, বৃক্ষটি কিন্তু সব দেখে রাখে, মুখে কিছু বলে না। এছাড়াও কত ঝড় বয়ে যায়,  সবি সহ্য করে নীরবে, কারণ সে জানে একদিন সকালে নতুন সূর্য পূর্ব আকাশে উদিত হবেই। আসলে এ আশা শুধু বৃক্ষটির একার নহে, এ আশা আমাদের সকলের। সব বিষাদ ধুয়ে মুছে আমরাও একদিন আগত দিনে সূর্যের মত হাসবই। এ দৃঢ় প্রত্যয় প্রতিনিয়ত প্রতিপন্ন করে চলছে পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি বৃক্ষ।

শীতকালে লোকজনকে দেখি নদীটির বরফের উপর হেঁটে হেঁটেই অপর পারে চলে যাচ্ছে। অনেকে এসে আবার নদীটির বুকে হাঁটতে হাঁটতে  তাঁদের পোষা কুকুরের গলার ফিতা ছেড়ে দেয়, আর মুক্ত কুকুরগুলো তখন আনন্দে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে ইচ্ছেমত। এ অবসরে কুকুরদের মালিকরা নিজেদের ভিতর একটুখানি খোশগল্পে মেতে উঠে। প্র্রথম প্রথম লোকজনের এরকম নদীর উপর দিয়ে হাঁটা দেখে একটু ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু কয়েকদিন অবলোকন করার পর বুঝতে পারলাম ভাসমান বরফের আস্তরন ভেদ করে নদীর নিচের পানিতে পড়ার হয়ত তেমন কোন আশঙ্কা নেই, তাই সবাই বেশ স্বাচ্ছন্দেই রিডো নদীটিতে পদব্রজে গমনাগমন করছে। আমিও একদিন ভয়ে ভয়ে তাঁদের দলে সামিল হয়ে খুব সতর্কতার সাথে নদীটির অপর পারে যাবার জন্য হাঁটা শুরু করলাম। অপর পারে এসে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করছি। যখন হাঁটছিলাম তখন মনে মনে ভাবছি সমুদ্র্রের চোরাবালির মত এ জমাটবাধা ভাসমান বরফের আস্তরন ভেঙে  যদি আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে আটকে দেয় তবে পরিণতি তো নিশ্চিত সলীল সমাধি। তখন কানাডার কোনো পুলিশও ধারণা করতে পারবে না এ পৃথিবীর সাতশত আশি কোটি মানুষের ভিতর একজন বরফে ঢাকা অটোয়া শহরের রিডো নামক একটি নদীর নীচে মৃতদেহ হয়ে মৎস্যকুলের আহার হয়েছে এবং আগামী গ্রীষ্মে যখন এ বরফ গলে তার স্বাভাবিকরূপে ফিরে আসবে তখন হয়ত এ পৃথিবীর অন্য মানুষদের আমার মাংসহীন অস্থির সাথে একটা যোগাযোগের ক্ষীণ সম্ভাবনা তৈরি হবে।

গ্রীষ্মে ওর তীরের পত্রহীন বৃক্ষগুলোতে প্রাণ ফিরে আসে। সবুজে সবুজে ছেয়ে যায় দুপাশ। বুনোঘাস লতাগুল্মের আগমনে মনে হয় প্রকৃতি তার স্বাভাবিকরূপে ফিরেছে। কত নাম না জানা ফুলের সাথে সাক্ষাত হল এ দুবছর ওর তীরে হাঁটতে হাঁটতে, কখনো বা বসে বসে। যখনি ওদের নাম জানার বাসনা জাগ্রত হয় তখনি আবার মনে পড়ে  থমাস গ্রে’র সে অমর স্তবক- FULL MANY A GEM OF PUREST RAY SERENE
THE DARK UNFATHOM’D CAVES OF OCEAN BEAR
FULL MANY A FLOWER IS BORN TO UNSEEN
AND WASTE ITS SWEETNESS IN THE DESERT AIR.

অর্থাৎ গ্রে বুঝাতে চেয়েছেন কতশত মনিমুক্তা অতল সাগরের একান্ত গহিনে লুকিয়ে আছে যার বিচ্ছুরিত রশ্মির ঝলক কোনোদিন দেখে না পৃথিবীর মানুষেরা, কতশত ফুল ফুটে নীরবে ঝরে যায় জনমানবহীন কত প্র্রান্তরে যার সুঘ্রান শুধু মিশে যায় এক অসীম আকাশে।

এখানে আমার সাথে দেখা হত বুনো হাঁসদের। দূর আকাশ থেকে ওরা নেমে আসতে শান্ত এ নদীটির বুকে। কখনো কখনো তীরে উঠে ওরা বিশ্রাম নিত।কাছে গেলেও সরে যেত না কারণ ওদেরকে এখানে কেউ জ্বালাতন করে না। এ হাঁসগুলোকে দেখলেই রফির কণ্ঠে গাওয়া একটি গানের কলির কথা মনে উঠত, ‘ না না পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না, ওকে গাইতে দাও/ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না’। গানটির গীতিকার যদি এখানের পক্ষিকুলকে পর্যবেক্ষণ করতেন তাহলে গানের কথা নিশ্চয়ই অন্যরকম হত। অনেক ছোট ছোট পাখিকে দেখতাম ঝোপের গাছের শাখায় নাচানাচি করতে। কাঠবিড়ালির তো কথাই নেই। সব গাছেই এদের অবাধ বিচরণ। অটোয়ার বৃক্ষরাজি কাঠবিড়ালিদের দখলে। রিডো তীরবর্তী গাছ-গাছালি মনে হয় ওদের হেডকোয়ার্টাস। কচ্ছপের প্রজনন সুবিধার জন্য  লোহার রড দিয়ে এক ধরনের খাঁচা তৈরি করে রাখা হয়েছে তীরঘেঁষে বিভিন্ন জায়গায়। আমি ভাবছিলাম এর ভিতর হয়ত কচ্ছপ ডিম পেড়ে রাখে। কিন্তু কোনো খাঁচায় কোনোদিন একটা ডিমও দেখলাম না। এককজন যুবক মাঝে মাঝে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি তুলত  যার সাথে আমার প্রায়শই দেখা হত তাঁকে একদিন ডিমশূন্যতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে জানাল খুব ভোররাতে বন্যপ্রাণী বিভাগের লোকজন এগুলি এসে নিয়ে যায় কৃত্রিম প্রজননের জন্য। উৎসায়ী হয়ে সে আরও জানাল কচ্ছপের বাচ্চাদের নাকি আশ্চর্যজনক এক ক্ষমতা আছে। ডাঙ্গায় ডিম ফেটে বের হয়ে পানিতে নেমে সোজা নাকি তারা তাদের মায়ের কাছে চলে যায় তা মা যেখানেই অবস্থান করুক না কেন। আমাকে এরকম ‘অ্যাম্ফিবিয়াস টর্টয়েস কিডস বিহেভিয়ার থিওরি’ শোনানোর জন্য হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম।

নদীর তীরের অগভীর পানির দিকে চোখ রাখলে কাদামাটিতে পা ছড়িয়ে রাখা নিস্তব্ধ কিছু ভেক বা ব্যাঙেরও দেখা মেলে মাঝে মাঝে। আগে কূপমণ্ডুকতার কথা শুনেছি কিন্তু বিষয়টা যে কুয়োর ব্যাঙ সম্পর্কিত তা জানতাম না। এ ব্যাঙেরা তাদের অগভীর কুয়োর ভিতর সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। অতলান্তিক মহাসাগরের বিশাল জলরাশির কথা যখন তাদেরকে বলা হয় তখন তারা তা বিশ্বাস করা তো দূরের কথা উল্টো জিজ্ঞেস করে সে জলরাশি তারা যে কুয়োটিতে বসবাস করছে সে  কুয়োটা ভরতে পারবে কিনা। রিডোর তীরে একাকী বসে  আকাশের নক্ষত্রদের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষজুড়ে এ  মহাবিশ্বের যে ব্যপ্তি সেখানে আমাদের পৃথিবীর আকার এতটাই ক্ষুদ্র যে সেটার তুলনা করলে কুয়োর ব্যাঙেরা  পৃথিবীর যে জায়গাটুকু দখল করে আছে তার ট্রিলিয়ন বা জিলিয়ন ভাগের একভাগও হবে না আমাদের এ ধরণিটা। মহাকাশ বিজ্ঞানী কার্ল সাগানকে যদি কাছে পেতাম তবে জিজ্ঞেস করতাম  এ বিশ্বজগতটা আসলে কোথায় এবং কেন অবস্থান করছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,’আকাশভরা সূর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ /তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি /আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে/জাগে আমার গান’।

একজনের কথা না বললে রিডোর তীরে আমার বিচরনের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যার কথা বলছি সে মাঝে মাঝে   পড়ন্ত বিকেলের দিকে এখানের একটি গাছের আড়ালে এসে এত সুন্দর সুরে বাঁশি বাজাত যে আমি সেটা নিয়মিত একাগ্র হয়ে শুনতাম। তার এ সুর ভেসে আসা মাত্র ওদিকটায় চলে যেতাম এবং একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে এটা উপভোগ করতাম। বেশি কাছাকাছি যেতাম না পাছে সে যদি বিব্রতববোধ করে। আমি যে দূর থেকে তার বাঁশির সুর শুনি এটা হয়ত তার চোখে ধরা পড়েছে। আমি কানাডা থেকে চলে আসার কিছুদিন আগে হঠাৎ এমনি এক বিকেলে আমি যখন একটু দূরে বসে তার সুর শুনছিলাম সে আমার কাছে এসে বলল, ‘তুমি বুঝি বাঁশি শুনতে খুব ভালবাস। আমি বললাম ‘হ্যাঁ, তোমার তোলা সুর খুব সুন্দর কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে তুমি কেন একা নির্জনে এখানে এসে বাঁশি বাজাও।’ সে যা বলল তা হল অনেক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় সে তার পরিবারের সবাইকে হারায়। একাই সে তখন বেঁচে ছিল। স্কুলে সে বাঁশি শিখেছিল। একবুক যন্ত্রণা নিয়ে যখন তার জীবন প্রচণ্ড অসহনীয় তখন সে তার প্রিয় স্কুল জীবনের  বাঁশিটি নিয়ে একদিন এ রিডো নদীর নির্জনে এসে বাজাতে থাকে এবং তখন তার এমন এক অনুভূতি জন্মাল যে মনে হল তার হারানো স্বজনেরা তার কাছে এসে এ সুর শুনছে। এতে তার যন্ত্রণার লাঘব হচ্ছে। আমি তাকে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমি যখন চলে আসতে যাচ্ছি তখন বাঁশিটায় সে যে গানটার সুর তুলল তাতে আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। গানটা ছিল,’এক পেয়ার কি নাগমা হ্যায়, মজো কি রয়োয়ানি হ্যায়/জিন্দেগি আউর কুচভি নেহি, তেরি মেরি কাহানি হ্যায়। ‘তার সুর শুনছি আর চলে যাচ্ছি। যখন কানে ভেসে আসছে, ’দো পলকা এ জীবন হ্যায়’ তখন খেয়াল করলাম আমার চোখও সিক্ত হয়ে গেছে।

#