বছরজুড়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দিবস পালিত হয়। তেমন ২২ অক্টোবর পালিত হয় ‘তোতলামি সচেতনতা দিবস’ হিসেবে। পৃথিবীর গতিময়তায় ক্যালেন্ডারের পাতায় আরও একটি ২২ অক্টোবর চলে এল। এবারের ২২ অক্টোবরের প্রতিপাদ্য ‘তোতলামি কোনো রোগ নয়, সহজেই ভালো হয়’’। বিশ্বজুড়েই তখন তোললামি সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। তোতলামি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে তোতলামি সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। কথা বলার সামান্য একটু ক্রটির কারণে কত মেধাবী মানুষও অবেহলিত থাকে। তাদের কথায় যাতে অন্যরা না হাসে, কেউ যাতে তাদেরকে হাসির খোরাক বা উপহাসের পাত্রে পরিণত না করে সে উদ্দেশ্যেই দিনটি পালন করা হয়। ভুক্তভোগীদের সাহস জোগানো, যথোপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া ও তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দিনটি পালন করা প্রয়োজন।
ইশারায় মনের ভাব প্রকাশের পরবর্তী ধাপে মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনেই কথা বলা বা ভাষার ব্যবহার করেছে। ভাষার বা কথার মাধ্যমে তার মনের ভাব পুরোপুরি ভাবে প্রকাশ করতে পারে। মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করলে যেমন মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। আবার অপ্রকাশে মানসিক বিকার বৃদ্ধি পায়। আমরা সেই দেশের মানুষ যে দেশের মানুষ শুধু ভাষার অধিকার, কথা বলার অধিকারের জন্য প্রাণ দিয়েছে, শহীদ হয়েছে। যা পৃথিবীতেই বিরল।
একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ শিক্ষিত, সৎ, বুদ্ধিমান ও সব রকম গুণসম্পন্ন কিন্তু কথা বললে যখন অন্যরা লুকিয়ে বা প্রকাশ্যে তার সম্মুখে অবজ্ঞার হাসি হাসে। সে তার মনের কথা কারও কাছেই খোলসা করে বলতে পারে না। সব সময় মানসিক অতৃপ্তি নিয়েই থাকতে হয়। মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হয়। তোতলামি নামক এই সমস্যার কারণে মেধার অকাল পতন হয়েছে। অবমূল্যায়নের কারণে অনন্য সাধারণ গুণাবলি হওয়া সত্ত্বেও জীবনে সফলতার দেখা পায়নি। এমন মানুষ আমাদের আশপাশে ও রয়েছে। পরিতাপের বিষয় সেই মানুষগুলোর মনের অবস্থা কেউ বোঝার চেষ্টাও করে না। আত্মীয়, বন্ধু এমনকি নিজের বাবা-মা ও কথা বলার এই ক্রটিজনিত সমস্যাকে গুরুত¦ দেয় না, কোনো চিকিৎসা নেই। এই বলে পাস কাটায়। কোনো কোনো বাবা-মা বকাবকিও করে।
আমার গত ১২ বছর এই সব মানুষদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেধাবী হয়েও অবমূল্যায়ন হয়, দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও স্বীকৃতি মেলে না। প্রেম-ভালোবাসাও তাদের কাছে টানে না। এমনকি বিবাহ পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হয়। জগৎ সংসারে এই মানুষগুলোর বেশির ভাগই অবহেলিত থাকে। দু’একজন হয়তো সমস্ত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যায় তাদের অদম্য প্রতিভাগুণে।
কারও কথায় ছলনা থাকে, কারও আবেগ আবার কারও প্রতারণার ছক এমন একটা সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকতে গেলে বাকপটুতা অপরিহার্য চতুপার্শ্বের মানুষগুলো তাদের কথার জালে আপনাকে আবদ্ধ করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করবে, ঠকাবে। সমযোগ্যতার চাকরিপ্রার্থীকে তোতলামির কারণে কম বেতনে বেশি সময় কাজ করাতে বাধ্য করে। আমার জানা একজন বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার শুধু তোতলামির কারণে কর্পোরেট সেক্টরে রিজেক্ট হয়ে পরিবারকে বাঁচাতে সামান্য বেতনের প্রাইমারি শিক্ষক হয়েছে।
তোতলামি আদতে শারীরিক কোনো সমস্যা নয়। এটা দীর্ঘদিনের বদভ্যাসগত ও মানসিকতাজনিত সমস্যা। এটা জন্মগত বা বশংগত কোনো রোগ নয়। একজন তোতলামিতে ভোগা মানুষ কিন্তু সব সময় আটকায় না, একই শব্দতে ও সব ক্ষেত্রে তোতলামি হয় না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রকমফের হয়। যখন সে একটি কথা বলে তখন কোনো শব্দতেই আটকায় না। নিজস¦ পরিমন্ডলে কথা বলার সময়ে খুবই কম হয়। কমফোর্ট জোনের বাইরের কথা বললে, অপরিচিত কারও সামনে, ক্লাসের প্রেজেন্টেশনে বা উচ্চব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কারও সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে খুব বেশি তোতলামি হয়। আর এরকমটা হয় মনস্তাত্ত্বিক কারণেই, শারীরিক ক্রটিজনিত কারণে হলে একই শব্দ সব ক্ষেত্রেই আটকে যেত বা কমফোর্ট জোনেও তোতলামি হতো। আশ্চর্যের বিষয় গান গাওয়ার সময় কিন্তু কোনো তোতলামি হয় না।
তোতলামি হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে বিভিন্ন কারণেই তোতলামি তোতলামি হতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ, কথায় জড়তা হয় বা তোতলায় এমন লোককে কপি (ভ্যাঙ্গানো) করতে গিয়ে। এর বাইরেও অন্যান্য কারণ আছে। যেমন-
* ছোটবেলা থেকে খুব বেশি আতঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন থাকতে হলে। * শিশুকালে কঠোর শাসনের ফলে। * আচমকা শারীরীক বা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে। * অতিদ্রুত কথা বলার কু-অভ্যাসের ফলে। * ভাবনা আর কথা বলা দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না হলে। * শিশুকালে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে ভয় পেলে এবং বারংবার ঐ ব্যক্তির সম্মুখীন হলে। * শিশুকালের কোনো অভ্যাস জোরপূর্বক বদল করলে। * শিশুকালে বাবা মা বা আপনজন ছাড়া একা কাটানোর জন্যও হতে পারে। * ভয়ঙ্কর কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলে। * প্রথম প্রথম স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অনুকূল না হলে। * কোনো রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। যেমন দীর্ঘকালীন জ্বর হলে হতে পারে। * মস্তিষ্কে আঘাত পেলেও হতে পারে। এর বাইরে আরও বিভিন্ন কারণ আছে, যার জন্য তোতলামি হয়।
* নতুন পরিবেশে কথা বলতে গেলে। * অপরিচিত মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হলে। * উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং কড়া ধাঁচের কারওর সাথে কথা বলতে গেলে। * নিজের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর বলার সময়। * ক্লাসে শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে। * মৌখিক পরীক্ষায়। * পরীক্ষার সময় উত্তেজনায়। * শারীরিক দুর্বলতায় বা বেশি ক্ষুধার সময়। * সামাজিক জনসমাবেশে। * হঠাৎ করে কোনো বিপদে পড়লে। * চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময়। * রেগে গেলে বা ঝগড়া করার সময়। * মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলে ও প্রচণ্ড ভয় পেলে। এছাড়া আরও কারণে বিভিন্ন সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতিতে তোতলামি বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ করে বিপদে পড়লে তো কথা বলাই বন্ধ হয়ে যায়।
* মেজাজ যখন ফুরফুরে থাকে। * নিজের কমফোর্ট জোনের মধ্যে কথা বললে। * নিম্ন সামাজিক অবস্থানের লোক অধস্তন কারও সাথে কথা বলার সময়। * কোনো সাফল্য অর্জন করার মুহূর্তে। * লোকে কী ভাববে এটা ভুলে কথা বলতে পারলে এছাড়াও এমন কিছু পরিবেশ বা পরিস্থিতি যা নিজের অনুুকূলে থাকে।
তোতলামি দূর করা আসলেই কঠিন নয়। তবে সারানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত যে কোনো মূল্যে এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। এবং একজন অভিজ্ঞ মেন্টরের তত্ত্বাবধানে সঠিক নিয়মে প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী প্রাকটিসগুলো করলে সহজেই তোতলামি দূর হয়। প্রথম ২/৩ দিন যথাযথভাবে প্রাকটিস করলে আত্মবিশ্বাস অনেকটাই ফিরে আসে। এভাবে ২০/২৫ দিন নিয়মিত প্রাকটিস করলে কথা বলাও বেশ সাবলীল হওয়া শুরু হয়। এসময় অত্যুৎসাহী হওয়া যাবে না। ধৈর্য সহকারে নিয়মিত প্রাকটিস করতে হবে। তবে তোতলামি দূর করার এই প্রক্রিয়া যত কম বয়সে করা যায় ততই ভালো। যদিও যে কোনো বয়সেই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা যতদিন বহন করে ততদিন মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হয়, লজ্জিত হতে হয়, অপমান অপদস্থ হতে হয়। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান করা যায় ততই মঙ্গল।
সকল অভিভাবককে বলব, আপনার বাচ্চার যদি এরকম সমস্যা দেখা যায় তাহলে তাকে বকাবকি করবেন না। কোনো টোটকার আশ্রয় নেবেন না, অবৈজ্ঞানিক কোনো কিছুতে ভরসা করবেন না। যেখানে গেলে সত্যিকার অর্থে তোতলামি ভালো হয় খোঁজ নিয়ে তাদের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নেবেন। এতে পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল তাদের জন্য সুখকর হবে। যোগ্যতার জয় হবে।
লেখক : তোতলামি সমাধানের পরামর্শক, stammeringremovecenter@gmai.com, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা ১২০৫