সরকার-শিক্ষকরা মুখোমুখি, উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা

: যথাসময় ডেস্ক
প্রকাশ: ৬ ঘন্টা আগে

ডিসেম্ব মাস শুরু। এ সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ মাসেই কয়েকদিনের জন্য ছুটি পায়। এ ছুটিতে তারা পরিবারের সঙ্গে কোথাও কোথাও ঘুরতে যায় শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে এবার যথাসময়ে বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে ছন্দপতন ঘটতে যাচ্ছে। অভিভারকরাও উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন। লাগাতার কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের পর তিন দাবিতে আদায়ে এবার কমপ্লিট শাটডাউনে যাচ্ছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। বুধবার থেকে এ কর্মসূচি পালন করবেন তারা। একই সঙ্গে শিক্ষকরা উপজেলা বা থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) অফিসের সামনে অবস্থান নেবেন। এদিকে, চারদফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত বৃহস্পতিবার ও রোববার মাউশি চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। দাবি পূরণে আশ্বাস না পেয়ে সোমবার থেকে তারা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেন। যার ফলে সারাদেশের ৭২১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে।

শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও শাটডাউনে স্থবির হয়ে পড়েছে প্রাথমিক ও সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা। তিন দফা দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ‘লাগাতার’ কর্মবিরতি- এটিকে ‘সরকারি চাকরি আইন ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা’র পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অবিলম্বে এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সরকারি কর্মচারী বিধিলঙ্ঘনের শামিল বলে জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার সতর্ক করেছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারাদেশে বর্তমানে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মরত। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সহকারী শিক্ষক। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বর্তমানে দশম গ্রেডে উন্নীত হয়েছেন। তবে সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তারা এ নিয়ে অসন্তুষ্ট। গ্রেড উন্নীতকরণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন।

কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা প্রাথমিকের শিক্ষকদের :

বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের পর তিন দাবিতে আদায়ে কর্মবিরতির পর এবার কমপ্লিট শাটডাউনে যাচ্ছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। মঙ্গলবার বিকেলে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, সারাদেশে আমাদের শিক্ষকরা কর্মবিরতি করছেন। দাবি আদায়ে কর্মসূচি করতে গিয়ে অনেকে হেনস্তান শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এজন্য আমরা বিদ্যালয় কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছি। রাত ৭টায় ভার্চুয়ালি সভা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেওয়া হবে।

শিক্ষকদের আরেক অংশের ‘তালা ঝুলানোর’ হুমকি :

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ যখন বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন করে বেতন বৃদ্ধি ও গ্রেড জটিলতা নিরসনের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন, তখন আরেকটি অংশ একই দাবিতে স্কুলে ‘তালা ঝুলানোর’ হুমকি দিয়েছেন।

শিক্ষকদের একাংশ ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ ব্যানারে বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রেখে মঙ্গলবারও পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন।
‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ বলেছে, এর মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে বৃহস্পতিবার থেকে স্কুলে তালা ঝুঁলিয়ে দেওয়া হবে।
ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আনিসুর রহমান মঙ্গলবার বলেন, ‘আমরা ঐক্য পরিষদ সোমবার রাতে ভার্চুয়ালি সভা করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবি বাস্তবায়নের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।’

সতর্কতামূলক চিঠি বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ডিজিকে শিক্ষকদের চিঠি :

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হুঁশিয়ারির পরও পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড় প্রাথমিকের শিক্ষকরা। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে সতর্কতামূলক চিঠি ও বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর উল্টো শিক্ষকরাও অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছেন।
প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের চারজন আহ্বায়কের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, তিন দফা দাবি আদায়ে সহকারী শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করে আসছেন। চলমান পূর্ণদিবস কর্মবিরতির পরিপ্রেক্ষিতে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা) বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি :

চার দফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গত বৃহস্পতিবার ও রোববার মাউশি চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। দাবি পূরণে আশ্বাস না পেয়ে সোমবার থেকে তারা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি শুরু করেন। যার ফলে সারাদেশের ৭২১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের চার দাবি- এক. সহকারী শিক্ষক পদকে ৯ম গ্রেডে নিয়ে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করা ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেট প্রকাশ; দুই. বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় নিয়োগ-পদোন্নতি দ্রুত বাস্তবায়ন; তিন. সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদান এবং চার. ২০১৫ সালের আগের ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বেতন সুবিধা পুনর্বহাল। এই শিক্ষকরা বার্ষিক পরীক্ষাসহ খাতা মূল্যায়নও বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের দাবি পূরণ বিষয়ে রূপরেখাসহ সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিলে তারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কর্মবিরতি স্থগিত করে পরীক্ষার কাজে অংশ নেবেন।

শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা গভীর উদ্বেগে :

সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চার দাবিতে লাগাতার কর্মবিরতি পালন করছেন। অনেক স্থানে পরীক্ষা হয়নি। শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কারণে দেশজুড়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। থেমে গেছে চলমান বার্ষিক পরীক্ষাও। অভিভাবকদের ক্ষোভÑ ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সরকারের একাধিক সতর্কতা জারি সত্ত্বেও দুই স্তরের সরকারি শিক্ষকরা দাবি আদায়ে আন্দোলন থেকে সরে আসেননি। ফলে সারাদেশে পরীক্ষার সময়সূচি ভেঙে পড়েছে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু জানান, সরকারি শিক্ষকরা যেভাবে চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করছেন, তা এর আগে আর দেখিনি। জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকরা দায়িত্বহীনতায় লিপ্ত। সারাবছর প্রস্তুতি নেওয়া শিশুরা শেষ মুহূর্তে মানসিক চাপে ভেঙে পড়ছে।
কঠোর অবস্থানে সরকার : শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বার্ষিক, নির্বাচনী ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নির্ধারিত সময়েই নিতে হবে জানিয়ে সোমবার নির্দেশনা জারি করেছে। শিক্ষকদের অনুপস্থিতি বা শৈথিল্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিক্ষা উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি :

শিক্ষকরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সরকারি কর্মচারী বিধিলঙ্ঘনের শামিল বলে জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। গণমাধ্যমমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. সি আর আবরার বলেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। সমস্ত জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তারা সবাই জানাচ্ছেন, পরীক্ষা দিতে ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী, অভিভাবকরা আগ্রহী। তবে একটি অংশ পরীক্ষা নিচ্ছে না। আমি বলবো, শিক্ষকরা আগামীকাল তাদের স্কুলের পরীক্ষা নেবেন। অন্যথায় তারা শাস্তির মুখোমুখি হবেন।

 

  • অভিভাবকরা
  • শিক্ষক
  • শিক্ষার্থী
  • সরকার
  • #